Bonobibi Jahuranama

Bonobibi Jahuranama

Bengali Title

বনবিবি জহুরানামা

Category
Puthi Literature

শোনো শোনো সুধীগণ শোনো দিয়া মন বনবিবির গল্পকথা করিব বর্ণন এক যে ছিল আল্লার ফকির, নাম বেরাহিম সঙ্গী ছিল ফুলবিবি– দোয়াগো করিম।

বেরাহিম-ফুলবিবির সংসারে সুখের কোনো কমতি ছিল না, কিন্তু একটাই অভাব স্বামী-স্ত্রীকে কুরে খাচ্ছিল। এতদিনের দাম্পত্যজীবন, তবু কোনো সন্তান নেই। সন্তানের আশায় দিনরাত তারা খোদার কাছে প্রার্থনা করে– “কী গুনাহে বলো গো, পাইলাম আমরা এমন শাস্তি– আল্লা তোমার দরবারে?” দু হাত তুলে বেরাহিম আল্লার কাছে ধর্না দেয়। একদিন ফুলবিবি এসে তাকে বলে, রসুলের কবরে গিয়ে সন্তানের প্রার্থনায় শেষ আর্জি দিতে। যদি তাও না আসে কোনো সন্তান তাদের সংসারে, তবে দুর্ভাগ্য বলে মেনে নেবে তাই।

এতদ্বারা মদিনায় পৌঁছিল বেরাহিম, তুলিল দুই হাত– মাঙিলো একখানা ফুটফুটে সন্তান। রসুলের মনে দয়া, জাগিলো কঠিন মায়া, কবর হইতে রসুল জাগিলেন তৎক্ষণে কহিলেন কথা, অতি সাবধানে–

“আমি নয়, শুধু আল্লাহই তোমার সন্তান প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেন।”

তবু প্রিয় বান্দার এমন দুরবস্থা দেখে বিবি ফাতেমার কাছে সাহায্য চাইতে গেলেন রসুল। তার কাছে জানা গেল, ফুলবিবি কখনো মা হতে পারবে না। বেরাহিমের ঘরে দুই সন্তান জন্ম নেবে, কিন্তু তাকে অবশ্যই অন্য কোনো নারীর সাথে বিয়ে করতে হবে। এই খবর শুনে বেরাহিম ফুলবিবির ছুটে গেলেন। “চাহিবামাত্র পূরণ করিতে হইবে” এমন শর্তে ফুলবিবি বুকে পাথর রেখে রাজি হলো নিজের স্বামীকে পরের কাছে পাঠাতে। বেরাহিমেরও মনে ফুলবিবি ছাড়া আর কেউ নেই, তবু সন্তানের আশায় সে চললো নতুন সঙ্গীর খোঁজে।

জলিল নামে মক্কার এক ফকির ছিল, তারই কন্যা চোদ্দ বছর বয়সী কুমারী গুলাল। তারই সাথে বিয়ে হলো বেরাহিমের। বিয়ের প্রথম রাতেই বনবিবি ও শাহ জঙ্গলির জন্ম নিশ্চিত হলো।

প্রথম মাহিনায় ছিল এমন, জলে ভাসে পদ্ম যেমন– তেমনি কালো ফোঁটা কারো তো জানা ছিল না– সেই গোপন কথা। দোসরা মাসে এলো রক্তের ফোয়ারা দুইখানা পুতুল যেন, সুন্দর চেহারা।

এভাবেই কেটে গেলো নয়টি মাস। দশম মাসে পা দিতেই ফুলবিবি ডেকে পাঠালো তার প্রাণপ্রিয় স্বামীকে, তার কাছে চাইলো সেই না চাওয়া বর।

“শোনো স্বামী আমার কথা, দিও না আর প্রাণে ব্যথা ফেলিয়া আসো গুলালকে এখনি গহীন জঙ্গলে।”

গর্ভবতী স্ত্রীকে জঙ্গলে ফেলে আসতে বুক কাঁপলো বেরাহিমের। কিন্তু কী উপায়! সে যে আল্লাহকে সাক্ষী রেখে কথা দিয়েছে ফুলবিবিকে, সে কথা রাখতেই হবে। ভুলভাল বুঝিয়ে গুলালকে নিয়ে সে রওনা দিলো জঙ্গলের পথে। দুর্বল গুলাল যখন আর পথ চলতে না পেরে শুয়ে পড়লো মাটিতে, সেই ঘুমন্ত বিবিকে রেখে বেরাহিম চললো বাড়ির পানে। আকাশ-বাতাস-বৃক্ষ-পক্ষী, সকলেই দুখী হলো গুলালের দুখেতে।

আঠারো ভাটির দেশে, যেখানে রাই-গাজীর দয়ায় সকলে বাঁচে, সেইখানেতে গুলাল বিবি জন্ম দিলো বেরাহিমের বহু প্রত্যাশিত সন্তানের মুখ। তবু সেখানে ছিল না পিতা, কিংবা কোনো মনিষ্যিসন্তান। ছিল শুধুই ঘন জঙ্গল আর খোদার পাঠানো চার পরী। সেই চার পরী গুলালকে বেহেশতি ফলমূল এনে দিয়ে সেবা করলো। বহু কষ্টের মাঝে, পরিবার পরিজন থেকে দূরে গুলাল বিবি জন্ম দিলো তার যমজ সন্তানদের। বনবিবি আর শাহ জংগলি। মনের সকল জ্বালা ভুললো সন্তানের মুখ চেয়ে, কিন্তু একা কী করে লালন-পালন করবে তাদের? এই ভয়ে পিছপা হলো গুলাল। ফেলে যেতে চাইলো সেখানেই। তখন গুলালের সাথে দেখা হলো এক হরিণের। সদ্যোজাত শিশুদের এভাবে ফেলে যেতে দেখে সেই হরিণ তাকে ধিক্কার দিলো।

“হায় হায় নির্দয় মাতা তুমি মানবী, আমি চেয়ে দেখো এক বনের হরিণী।”

হরিণীর কথা শুনে কিছুক্ষণের জন্য হতভম্ব হলেও গুলাল বিবি নিলো এক নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত। বনবিবির জন্ম হয়েছিল শাহ জংগলির কিছুক্ষণ আগে। সে অনুযায়ী বয়সে সেই বড়। তাই ছোট সন্তান জঙ্গলিকে রক্ষা করতে বনের গহীনে কন্যাটিকে ফেলে গেল গুলাল। সদ্যোজাত বনবিবি জন্মের কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবা-মা থাকা সত্ত্বেও হয়ে গেল এতিম। সে তখনো কথা বলতে শেখেনি, তবু হৃদয়ে তার স্রষ্টার প্রতি ভক্তির শেষ নেই। আকাশপানে চেয়ে সে প্রার্থনা করলো।

সেই প্রার্থনা পৌঁছালো আল্লাহর দ্বারে। তিনি বনের সকল হরিণীকে বললেন,

“যাও তোমরা যাও ছুটে, চেয়ে দেখো বনবিবি পড়ে আছে জঙ্গলে। তাকে পেলেপুষে বড় কোরো, তোমরা সবাই দলেবলে।”

এরপর হরিণীদের কাছেই নিজ সন্তানরূপে বেড়ে উঠতে থাকলো বনবিবি। ওদিকে বনেরই আরেক প্রান্তে, মায়ের সাথে বড় হলো শাহ জঙ্গলি। একই মায়ের ওরসে জন্ম যাদের, তাদের আলাদা হতে হলো জন্মেরই পরপর। এভাবেই কেটে গেলো সাত–সাতটি বছর। একদিন তাদের কাছে ভেসে এলো পরম করুণাময় আল্লাহর বাণী, “তোমরা দুজনেই যাবে সুন্দরবনের জলাভূমিতে।”

এদিকে অনুতাপে জর্জরিত বেরাহিমের মন, সে যে বহু বছর ধরে শান্তিতে ঘুমায়নি। গর্ভবতী স্ত্রীকে ফেলে এসেছে গহীন জঙ্গলে, তার মনে কি দুঃখের শেষ আছে? এবারে সে ফুলবিবির কাছে গিয়ে বললো, “আমি পাপ করেছি। এ পাপের জন্য কোনো ক্ষমা নেই। আমি এখনই খুঁজতে যাব গুলাল বিবি ও আমার সন্তানকে।” এই বলে সে বেরিয়ে পড়লো। অনেক পথ হেঁটে সে দেখা পেলো তাদের। এক গাছের তলে বসে আছে গুলাল বিবি ও শাহ জঙ্গলি। খাদ্যাভাবে, শক্তির অভাবে দুজনেরই শরীর দুর্বল। তাদের ঘরে ফিরিয়ে নিতে চাইলো বেরাহিম। কিন্তু এত বছরের পর গুলাল বিবি শরীরে দুর্বল হলেও মন তার হয়েছে পাথরের মতোই কঠিন। স্বামীকে ফিরিয়ে দিয়ে সে ছুটে চললো বনের আরো, আরো গভীরে। এত বছরেও দেখা মেলেনি যার, তারই দেখা মিললো এবার। বনবিবি দেখতে পেলো তার মা-বাবা ও ভাইকে। মা-বাবার প্রতি তার কোনো আশা-ভরসা তো ছিল না, কিন্তু এই ভাইয়ের সাথেই যে সে মায়ের গর্ভে থেকেছে দশ মাস দশ দিন। তাকে ভোলে কী করে?

“চলো শাহ জঙ্গলি হাত রাখো হাতে ভাইবোন এক হবো, চলো আমার সাথে।”

মা-বাবা তাদের আটকানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু তারা যে পেয়েছে খোদার আদেশ– যেতেই হবে আঠারো ভাটির দেশ। বহু কষ্টে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ভাইবোনে মিলে রওনা করলো মক্কার পথে। সেখানে দোয়া নিতে হবে বিবি ফাতেমার। বিবি ফাতেমার সমাধির কাছে বসে তারা দোয়া চাইলো। ভেসে এলো এক অলৌকিক বাণী–

“শোনো শোনো বনবিবি, শোনো দিয়া মন– আমারই আদেশে করো এখনই গমন। আঠারো ভাটির দেশে আছে বহু জলাভূমি, আঠারো হাজার লোক আছে, গিয়েছে ভুলে খোদার পথ তারা– তোমরা গেলে পড়বে তাদের মনে সাড়া মা বলে ডাকবে তোমায়, থাকবে সন্তানরূপে। বনবিবি, যাও সেইখানে ছুটি।

বিবি ফাতেমার কথা শুনে বনবিবি বুঝতে পারলো, তাদের জীবনের উদ্দেশ্য কী। নবীজীর সমাধির কাছে গিয়ে এরপর দুজনেই খেলাফত হবার দাবি রেখে হাতে নিলো তসবি, মাথায় পরলো কালো টুপি আর শরীরে জড়ালো আলখাল্লা। হেঁটে চললো মদিনার পথ ছাড়িয়ে সুন্দরবনের পথে। পথে পেলো গঙ্গার জল, সেই জলে পা না ডুবিয়ে তীর ধরে হাঁটতে থাকলো খোদার দুই দূত– বনবিবি আর শাহ জঙ্গলি।

মদিনার পথ থেকে বিবি ফাতেমা ও নবীজীর দোয়া মাথায় করে বনবিবি ও শাহ জঙ্গলি এইবারে এসে পৌঁছালেন সুন্দরবনের জলাভূমিতে, যেখানকার হর্তাকর্তা দক্ষিণ রায় নামের এক অধিপতি। তাকে অনেকে বাঘের রাজা বলেও ডাকে। আর এই সুন্দরবনেই লেখা আছে ভাইবোনের ভাগ্য। গঙ্গার পাড় ধরে হেঁটে চলেছেন নবীর পাঠানো দুই খেলাফতি। প্রথমেই তাদের সাথে দেখা হলো সেখানকারই এক নিম্নজাতির বাসিন্দা ভাঙ্গড় সাহার সঙ্গে। ভাঙ্গর তাদেরকে আঠারোভাটির দেশ, সেখানকার শাসক ও সামগ্রিক অবস্থার কথা খুলে বললো। বললো দক্ষিণ রায়, চাঁদ রায়দের কথা।

কোথায় গেলে পাবে শাসন, কোথায় যাওয়া বারণ– এ সকলই সে করিলো বর্ণন। দুই হাত তুলি ভাঙ্গড় কহিলো সম্মানে “ওগো বিবি কোন কাজে, আসিলেন এইখানে?” জবাব দিলেন বনবিবি, মুচকি হাসি হেসে– “আমরা দুই ভাইবোন– যমজ সন্তানে, রাসুলের আদেশে আসিয়াছি এইখানে। খেলাফত দেয় নবী, বাকি কর্ম বৃথা সবি আঠারোভাটির দেশে আমরা এখন ধর্ম প্রচার করি।”

ভাঙ্গড়ের কাছে তখন তারা জানতে পারলেন যে সুন্দরবনের নিম্নাঞ্চল আর খুব একটা দূরে নয়। কিছুদূর এগোলেই তারা পৌঁছে যাবে দক্ষিণ রায়ের অঞ্চলে। বিস্তারিত সব তথ্য বলে দিয়ে ভাঙ্গর তাদের দুইজনকে সাহায্য করলো। ভাঙ্গড় সাহাকে যারপরনাই ধন্যবাদ জানিয়ে ভাইবোন রওনা দিলেন বাদাবনের পথে।

দক্ষিণ রায়ের অঞ্চলে গিয়ে তারা দেখতে পেলেন, সেখানে কারো মনে ধর্মের ভয় নেই। কারো মধ্যে নেই নীতি-নৈতিকতার বালাই। শুধু তাই নয়, জঙ্গলভর্তি শুধু ভূত-প্রেত আর ডাকিনী-যোগিনীর বাস। বনবিবি ভয় পেলেন না, অভয় দিলেন শাহ জঙ্গলিকেও। বনবিবির আদেশে তখন সকল বাসিন্দার প্রতি উদ্দেশ্য করে জঙ্গলি এক গগনবিদারী আযান দিলেন। নামাজের সেই আহ্বানে চারিদিকে মনে হলো যেন ভূমিকম্প হবার যোগান! “আজানের আওয়াজেতে, ভূত না পারে টিকিতে”। সে ডাক পৌঁছালো দক্ষিণ রায়ের কানেও– “কোন সে যোদ্ধা দেখো মাতিছে উল্লাসে, কী বাসনা দেখো সে এমনে প্রকাশে?” ভীষণ ক্ষেপে গেলেন তিনি। তার অঞ্চলে এমন সাহস কে করছে? কোত্থেকে এসেছে তারা? এখনই নির্মূল করতে হবে এই আগন্তুকদের।

তখনই চেলা-চামুণ্ডাদের পাঠিয়ে দিলেন দক্ষিণ রায়। তাড়িয়ে দিতে চাইলেন বনবিবি ও শাহ জঙ্গলিকে সুন্দরবনের নিম্নভূমি থেকে, তার বিশাল শাসনের অঞ্চল থেকে। কিন্তু তাদের কেউই খুব একটা সুবিধা করতে পারলো না, বনে গিয়েও ফিরে এলো ভয়ে। এরই মধ্যে একজন ছিল সনাতন, সে এসে খবর দিল প্রভুকে– “সম্ভব নয় তাড়ানো এদের, করিছে বসি আল্লার নাম– নারী-পুরুষ দুই মুসলমান”। এমনতর উটকো ঝামেলায় বেশ বিরক্তই হলেন রায় মহাশয়। ভাবলেন, এক্ষুণি লড়াই করে তাড়িয়ে দেবেন তার অঞ্চলের অনাহুত এইসব অতিথিকে– “তাড়াইয়া দাও শত্রু জবন, ডাকিব এখনই যুদ্ধের শমন!” কিন্তু যুদ্ধবিদ্যায় দক্ষিণ রায়ের মা, রায়মাতা রায়মণিও কম যেতেন না। তার মাথায় তখন এলো এলো অন্য বুদ্ধি। তিনি চাইলেন না এক নারীর সাথে যুদ্ধে পরাজিত হোক তার ছেলে। এর চেয়ে বরং নিজেই নেমে পড়বেন যুদ্ধভূমিতে, যা আছে কপালে! দক্ষিণ রায়কে ডেকে তিনি বললেন,

“বলিছ এ কী তুমি পুত্র? পুরুষ হয়ে লড়বে নাকি তুচ্ছ এক নারীর সাথে– লইবে তুমি অস্ত্র হাতে, ধরিবে তুলি শস্ত্র কাঁধে? আমিই যাব যুদ্ধে চলি, করিব তাহাই, যাহা বলি।”

যে-ই কথা, সে-ই কাজ। এই ঘোষণা দিয়ে রায়মণি চলে গেলেন বনবিবির নিস্তার করতে। গরিমায় দাপটে রায়মণির পা যেন মাটিতে পড়ে না। বহু অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত তিনি, সেজেছেন যুদ্ধসাজে। আকাশে-বাতাসে তার সাথে ভেসে চললো হাজারো ডাকিনী-প্রেতাত্মা, শ্মশানের অধিবাসী, ভূত-প্রেত যত ছিল। সকলেই এক সুরে লড়াইয়ে নামলো দক্ষিণ রায়ের পক্ষে। তাদের সবার মুখে তখন একটাই কথা– “হত্যা! হত্যা!”

শান্তিতে ধর্মপ্রচারের কাজ করবেন বলে ভেবেছিলেন বনবিবি। কিন্তু সামনে থেকে আক্রমণ এলে কী আর করা? নিজেকে রক্ষা করাও যে ধর্মেরই কথা। বনবিবিও তাই প্রস্তুত হলেন তার রথ নিয়ে। প্রতিটি আক্রমণের আগে বনবিবি আল্লা-রাসুলের নাম নেন, আর তাতেই কায়দা হয়ে যায় রায়মণির সব অস্ত্র। একের পর এক ডাকিনী-যোগনীবিদ্যার অস্ত্র নিক্ষেপ করেন, তবু ঠিক বশে আনতে পারেন না বনবিবিকে। যতই বাণ নিক্ষেপ করেন, বনবিবির শরীর ভেদ করে তা চলে যায় বহু দূরে– মনে হয় যেন জল দিয়ে গড়া হয়েছে তার শরীর।

“রায়মণির তিন বাণ হইয়া গেল খান খান।”

এমন অবস্থায় বনবিবিকে হত্যা করতে রায়মণি শেষমেশ একটি তীক্ষ্ণ ফলার ছুরি হাতে নিলেন। চড়ে বসলেন বনবিবির রথে, তার উপরে। কিন্তু বিবি ফাতেমার দোয়ায়, গলা থেকে ঝুলতে থাকা তাবিজের শক্তিতে রায়মণি, বনবিবির একটি চুলও বাঁকা করতে পারলেন না। ছুরি হয়ে গেলো ফুল, সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। বনবিবির গায়ে ফিরে এলো লড়বার শক্ত। রায়মণিকে পরাস্ত করলেন তিনি, তবে প্রাণে মারলেন না।

এমন অলৌকিক দৃশ্য দেখে আর পরাজয়ের গভীর শোকে রায়মণির হাত থেকে সকল অস্ত্র পড়ে গেলো মাটিতে। চোখে এলো জল। দুই হাত জোড় করে, হার মেনে রায়মণি তখন ক্ষমা চাইলেন বনবিবির কাছে। মেনে নিলেন তার শাসন–

“তুমিই হবে বাদাবন– এই আঠারোভাটির রাজা, আমরা সকলে হইলাম আজি তোমারই প্রজা।”

এভাবেই বনবিবি একে একে সুন্দরবনের সকল নিম্নভূমির অধিষ্ঠাত্রীরূপে পরিচিত হতে লাগলেন। প্রজাদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো তার নাম। ওদিকে রায়মণিও বেশ কিছুদিন তার উপদেষ্টা হয়ে তাকে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করলেন। এরপর একদিন বনবিবি তার ভাইকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন সমগ্র অঞ্চল ঘুরে দেখতে, রায়মণিকে সকল সহায়তার জন্য ধন্যবাদ পাঠিয়ে দিলেন আপন নিবাসে। ঘুরতে ঘুরতে একদিন তারা এসে দাঁড়ালেন ভুরকুন্ড নামের এক স্থানে। সেখানকার বন-জঙ্গল, প্রকৃতি দেখে আবেগে অভিভূত হলেন বনবিবি। ভাই শাহ জঙ্গলির দিকে তাকিয়ে নিলে সাথে থাকার পণ–

“শোনো ভাই ডর নাহি করিবে কাহারে, মকেদ হইয়া থাকো সঙ্গেতে আমার।”

ভুরকুন্ডের সেই বনেতেই তারা স্থাপন করলেন তাদের এক স্থায়ী ঠিকানা, যেখান থেকে পুরো অঞ্চলকে পথ দেখিয়ে চলবেন ধর্মের পথে– নীতির পথে। সকল হর্তাকর্তার জন্য বনবিবি নির্দিষ্ট করে দিলেন সীমানা, কেউ যেন কারো গণ্ডি না পেরোয়।

“বোনবিবি সর্দ্দার হইলো সকলের। রাখে আল্লা, মারে কে? কহিলো খাতের।”

সেই হতে বনবিবি সুন্দরবনের সকলের রক্ষা করে চলেন। ভাইয়ের সাথে থাকেন বনেরই মাঝখানে। তার নামে বাদাবন, নিম্নভূমির সকলেই শ্রদ্ধা রাখে। বনবিবির জহুরানামা ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মুখে মুখে।