গাজী, কালু, চম্পাবতীর আখ্যান
বাংলা
বহুকাল আগের কথা। সেই সময় বিরাটনগরের রাজা ছিলেন শাহ্ সিকান্দার আর রানী ছিলেন অজুপা সুন্দরী। তাদের প্রথম সন্তান জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে হারিয়ে যাওয়ায় তাদের মনে ছিল ভীষণ দুঃখ। একদিন রানী যখন বিষন্ন মনে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, তখন তিনি পানিতে একটি কাঠের সিন্দুক দেখতে পান। তিনি জলে নেমে হাত বাড়িয়ে সিন্দুকটি নিজের কাছে টানলেন। তারপর খুলে দেখলেন ভিতরে ছয়-মাস বয়সের একটি শিশু। বহুদিন চেষ্টা করেও যখন শিশুটির বাবা-মাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না, তিনি নিজেই তাকে দত্তক নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। পরম সুন্দর শিশুটির নাম রাখা হলো কালু। এভাবে অনেক দিন পার হল। এক রাতে রানী স্বপ্নে দেখলো আকাশের চাঁদ এসে তার পেটে ডুবে গেলো। রানী ছুটে গেলেন রাজার কাছে এবং এই স্বপ্নের অর্থ জানতে চাইলেন। রাজা তাকে আশ্বাস দিলেন যে তার পেটে সুসন্তান জন্ম নিতে যাচ্ছে। কয়েক মাস পর রাজার কথা সত্যি হল। চাঁদের মতোই ঘর আলোকিত করে জন্ম নিলো এক পুত্র সন্তান। নাম রাখা হল তার গাজী শাহ। ছোট ভাই, গাজীকে, অসম্ভব ভালোবাসা দিলেন কালু। হয়ে উঠলেন তার সারাজীবনের সঙ্গী।
প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর থেকে রাজ্যের শাসন ভার গ্রহণের জন্য চাপ আসতে থাকে গাজীর ওপর। কিন্তু এসবের প্রতি তার বিন্দুমাত্র আকর্ষণ ছিলো না কারণ ইহজাগতিক মায়া তাকে স্পর্শ করতে পারতোনা। সে চাইতো ফকির হয়ে সৃষ্টিকর্তার পথে নিজেকে সমর্পণ করতে। রাজা অসন্তুষ্ট হয়ে গাজীর ওপর চালাতে থাকে অকথ্য নির্যাতন। এমনকি তাকে মেরে ফেলার ভয়ও দেখানো হয়। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল থাকে গাজী। অবশেষে কোন উপায় না দেখে রাজা গাজীর ফকিরের ক্ষমতার একটি পরীক্ষা নেয়ার প্রস্তাব করলেন। গাজী এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে রাজ্য শাসনের দায়িত্ব থেকে তাকে মুক্তি দেয়া হবে। একথা বলে রাজা গভীর সাগরে একটি সুঁচ নিক্ষেপ করলেন যাতে তিনি পরীক্ষা করতে পারেন গাজী তা উদ্ধার করতে পারে কি না। গাজীর বিশ্বাস ছিল যে খোদা অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারে। তাই তিনি প্রার্থনায় লিপ্ত হয়ে গেলেন। খোদার আদেশে পাতালপুরী হতে উঠে এলো সমুদ্রগর্ভের দেবতা খাজা খিজির। খিজির নিজের পরিচয় দেয়া মাত্র গাজী তার পায়ে পড়ে সালাম করেন। তারপর তিনি তাকে সব খুলে বলেন। সব শোনার পর খিজির তার দুই দানব সন্তান শুরা এবং শুরি কে ডাক দেন। তারা দুইজন মিলে সমুদ্রের সব পানি চুষে ফেলে। কিন্তু কোথাও সেই সুঁচ পাওয়া যায় না। গাজী তখন আল্লাহর কাছে আবারো সাহায্য চেয়ে ধ্যান মগ্ন হলেন। ধ্যানের মধ্যে গাজী দেখলেন যে সুঁচটা পানিতে পড়ার পর এক মৎস্যকুমার সেটিকে নিয়ে পাতালনগরে চলে যায় । সেখানে গিয়ে সুঁচটি ব্যবহার করে একটি পরীর চুল বেঁধে দেয় সে। অতঃপর গাজী খিজিরকে আল্লাহর কাছ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের কথা জানালেন। তারপর খিজির এর আদেশে তার দানব সন্তানরা পাতালনগরে গিয়ে সুঁচটি নিয়ে আসে। সুঁচ নিয়ে গাজী এবং কালু রাজার কাছে ফিরে যায় এবং নিজের আলৌকিক ক্ষমতার প্রমাণ দেয়। অবশেষে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গাজী ও কালু রাজ্য ত্যাগ করে বনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
অনেকদিন জঙ্গলে ঘুরার পর দুইভাই পৌঁছায় ছাপাইনগরে। তখন সেখানকার রাজা ছিলেন রাজা শ্রীরাম। তারা রাজার প্রাসাদে পৌঁছে তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলে রাজা খুব রাগান্বিত হোন এবং তাদের দুজনকে অপমান করে নিজ রাজ্যের বাইরে বের করে দেন। দুই ভাই রাজ্য থেকে বের হয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। মনে কষ্ট নিয়ে কালুর মাথায় চিন্তা আসে, "এমন যদি হতো যে রাজপ্রাসাদে আগুন লেগে যেতো এবং আকাশ থেকে জ্বিন নেমে এসে রানী কে অপহরণ করতো"। কালুর এই দোয়া আল্লাহর দরবারে কবুল হয়, হঠাৎ রাজবাড়িতে আগুন লাগে। এমন আগুন যে সেইটা কেউ নিভাতে পারছিলো না। এর মধ্যে ছাপাইনগরের রাণীও অপহৃত হয়। কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না তাকে। রাজা অনেক ভেবেও কোনো কূলকিনারা পেলেন না। সবাই বলাবলি করতে শুরু করলো, এসব গাজী-কালুর সাথে রাজার করা খারাপ আচরণের ফল। তারা ব্যতীত আর কেউই পারবে না এই ঘোর বিপদে রাজাকে সহায়তা করতে। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই রাজা তাদের শরণাপন্ন হলেন। নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইলেন তাদের কাছে। গাজী-কালু শর্ত দিলেন যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেই তাদের ক্ষমা করা হবে। রাজা তৎক্ষনাৎ কলেমা পড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ফেলেন। কালু গাজীর পা থেকে ধুলো নিয়ে প্রাসাদের দিকে ছিটিয়ে দিলেন। নিমিষেই আগুন নিভে গেলো। রাণীকেও দেখা গেল।
গাজী নিলো, গাজী-ই দিলো সাক্ষী আল্লাহ তাই, প্রাসাদের আগুন নিভায় কালু ছিটাইয়া পায়ের ছাই।
এই ঘটনার পর গাজী কালু আবার বনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। পথ চলতে চলতে তাদের দেখা হলো সাতজন কাঠুরিয়ার সাথে। তাদেরকে দেখে কালু বললো, "আমি অনেক ক্লান্ত অনুভব করছি। আজ কাঠুরিয়ার বাড়িতেই রাত্রিযাপন করি।” নিজেদের পরিচয় দেয়া মাত্রই কাঠুরিয়ারা তাদের ঘরে আমন্ত্রণ করলো। দুই পীরকে বসিয়ে রেখে তাদের স্ত্রীদের বললো রান্নার আয়োজন করতে। স্ত্রীরা তখন বলে উঠলো,
বাজারেতে যাহা চলে আনো তাহা সেতাবি করিয়া নুন তৈল কোথা পাই, ডাল-চাল কিছু নাই দিবো কিসে আমরা রান্দিয়া।
এ কথা শুনে কাঠুরিয়ারা তাদের দাও-কুড়াল বন্ধক রেখে বাজার করে আনল এবং তা দিয়েই বাড়ির গিন্নিরা রান্না করে গাজী-কালুকে খাওয়াল।
পরের দিন বনের উদ্দেশ্যে পুনরায় রওনা দেয়ার আগে গাজী পীর সিদ্ধান্ত নিলেন যে উনি কাঠুরিয়াদের ঋণ পরিশোধ করবেন। তিনি বিকট শব্দ করে "শাহ পরী" নামের কাউকে ডাক দিলেন। আকাশ থেকে নেমে এলো পরীদের বাদশা। গাজী তাকে বনের অধিবাসীদের জন্য বিশাল বড় এক সোনার মসজিদ বানানোর নির্দেশ দিলেন। পরীদের বাদশা গাজী পীর-এর পায়ে পরে বললেন যে এই কাজ উনি একা করতে পারবেন না। এর পর গাজী পীর এর অনুমতিতে আকাশ থেকে নেমে এলো হাজার হাজার পরী। জঙ্গল কেটে একটা সোনার মসজিদ বানানো হলো। দুই ভাই এর জন্য হীরা খচিত দুই সিংহাসন বানানো হলো। সেই মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলো সোনাপুর শহর। এতো সুন্দর শহর পৃথিবীতে আর কোথাও ছিলো না। যেই দেখতো সেই মোহিত হয়ে যেতো। মনে করতো- 'আমি বুঝি মরে স্বর্গে চলে এসেছি'! শহরের মানুষজন খুব আনন্দ এবং প্রাচুর্যে দিন কাটাতে লাগলো।
সোনাপুরে রহে গাজী হরিস অন্তরে আনন্দের সীমা নাহি প্রতি ঘরে ঘরে গাজী আর কালু সাহা মসজিদ মাঝে বসিলেন সিংহাসনে মনোহর সাজে দেখিয়া গাজীর রূপ পরান জুড়ায় খিদা, তৃষ্ণা, নিদ্রা, ব্যাথা সকলি পালায়
এক রাতে দুই ভাই মসজিদ এর ভিতর ঘুমাচ্ছিলো। ওই সময় সাত জন পরী একটি রথ-এ চড়ে মক্কা থেকে ফেরত আসছিলো। পথে ওরা সোনাপুর এর চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যাত্রা থেকে বিরতি নেয়। তারা মসজিদ এর জানালা দিয়ে দেখে গাজীর শরীর থেকে বেহেশতী নূর ঝিলমিল করছে। এমন সৌন্দর্য বর্ণনা করার ভাষা পরীদের কাছে ছিলো না। গাজীর নূর এর কাছে চন্দ্র এবং সূর্যের আলো ও মনে হয় মলিন। হঠাৎ একজন পরী বলে উঠলো, "এই দুনিয়াতে কি এমন কোনো নারী আছে যার সাথে গাজীর সৌন্দর্যের তুলনা হবে?" আরেকজন বললো, "আছে…. একমাত্র একজন রাজকন্যাই আছে যাকে গাজীর সাথে মানাবে, ব্রাহ্মণ নগরের মুকুট রাজার কন্যা চম্পাবতী।"
এক কন্যা আছে আমি যাহা জানি নীন্দই গগন-শশী সেই বিনদিনী হেন রূপ না পাইছে দেবতা কিন্নর মুখের লাবণ্য যিনি কোটি শশধর
শুধুমাত্র একটি সমস্যা, কন্যাকে সবসময় ঘিরে থাকে তার সাত ভাই এবং রাজার সেনাপতি দক্ষিণ রায়।
পরিগনে বলে তাহা বিশ্বাস না হয় চক্ষে না দেখিলে করিব না প্রত্যয় এক পরী বলে শুনো মোর কথা গাজীকে লইয়া চলো যাই চলে তথা
যেই কথা সেই কাজ। পরীরা তৎক্ষনাৎ ঘুমন্ত গাজীর খাট ধরে তাকে আকাশে উড়িয়ে নিয়ে ব্রাহ্মণ নগরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। ব্রাহ্মণ নগরে যখন পরীরা পৌঁছায় তখন গভীর রাত। প্রাসাদের সব প্রহরীরা ততক্ষনে ঘুমিয়ে পড়েছিল। পরীরা চম্পাবতীর ঘরের জানালা দিয়ে গাজীর খাট উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে রাজকন্যার খাটের পাশে রাখলো। মনে হচ্ছিলো যেন সূর্য ও চন্দ্র একত্রিত হয়েছে। রাতে বিছানায় পাশ ফিরতে নিয়ে চম্পাবতীর শরীরে গাজীর হাত পড়লে চম্পাবতী জেগে উঠে। সে ভাবে তার দাসী হয়তো তাকে জাগিয়েছে। কিন্তু সে চোখ খুলে তার বিছানার পাশে পরম সুন্দর এক পুরুষকে দেখতে পায়।
পরে স্বতী চম্পাবতী পালংকে বসিয়া দেখেন গাজীর রূপ স্বচক্ষে চাহিয়া ক্ষনে দেখে চক্ষু কান, ক্ষনে দেখে বুক ক্ষনে দেখে হস্ত পদ, ক্ষনে দেখে মুখ লক্ষ-কোটি চন্দ্র যেন তার মুখ খান ছটফট করে কন্যা হারাইয়া জ্ঞান।
চম্পাবতী চিৎকার করে বলে উঠলো, “ওরে চোর ! ওঠো, তোমার সাহস কীভাবে হলো আমার মন্দিরে প্রবেশ করার”। তার কথায় গাজীর গভীর ঘুম ভেঙে যায়। যখন তিনি চোখ খুললেন, তিনি চম্পাবতীর সৌন্দর্যে এতটাই বিস্মিত হলেন যে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। চম্পাবতী তখন গোলাপজল এনে গাজীর মুখে আলতো করে ছিটিয়ে দিলে তিনি আবার জেগে ওঠেন। নিজেকে নতুন জায়গায় দেখে গাজী হকচকিয়ে উঠে বললেন- "কোথায় আমি? মসজিদ কোথায়? এটা কার প্রাসাদ?” চম্পাবতী বললো- "শোনো চোর, ব্রাহ্মণ নগরের মুকুট রাজার নাম নিশ্চয়ই শুনেছ। যেখানে প্রবেশের অনুমতি শুধু ব্রাহ্মণদেরই দেওয়া হয়। তুমি কি রাজার সেনাপতি দক্ষিণ রায় কে ভয় করো না? সে তোমাকে চোখের পলকে ধ্বংস করতে পারে। তুমি কোথা থেকে এসেছ বলো?" গাজী তারপর সোনারপুরে মসজিদে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত পুরো ঘটনা খুলে বললেন। যখন তিনি কথা বলছিলেন তখন রাজকুমারী চম্পাবতী কৌতূহলবশত তাদের দুজনের জন্মকুন্ডলী দেখছিলো।
তবে স্বতী চম্পাবতী খড়ি লইয়া হাতে দুই নাম যুক্ত করে লাগিল গণিতে গনিয়া দেখিলো কন্যা লিখেছে বিধাতা গাজীর সঙ্গেতে চম্পা এক সুতোয় বাধা
রাজকুমারী বললো, “আমি একজন ব্রাহ্মণ নারী আর তুমি একজন মুসলিম পুরুষ। কিন্তু মনে প্রাণে আমি বিশ্বাস করি, ঈশ্বর আমাদেরকে একে ওপরের জন্য বানিয়েছেন। আপনি যেহেতু ফকিরের জীবন বেছে নিয়েছেন, আমিও ফকিরনী হবো। আমরা দু'জনে দ্বারে দ্বারে গিয়ে খাবারের জন্য ভিক্ষা করব এবং শিব ও দুর্গার মতো চিরকাল একসাথে থাকব।" তখন চম্পাবতী তার চুল দুই ভাগ করে গাজীর পায়ে ঘষে হিন্দু রীতি অনুযায়ী গাজীকে স্বামী হিসাবে স্বীকার করে নিলো। আংটি বিনিময় করে তারা দুজন বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। এই দেখে পরীরা আবারও গাজীর খাট কাঁধে নিয়ে সোনাপুরের উদ্দেশে উড়াল দিলো।
পরের কয়েকটা দিন ছিল গাজীর জন্য খুব কষ্টের। চম্পাবতীর চেহারা তিনি মাথা থেকে বের করতে পারেননি। তিনি মরিয়া হয়ে সোনাপুর ছেড়ে ব্রাহ্মণ নগরের সন্ধানে বনে ঘুরে বেড়াতে শুরু করলেন। গাজীর পাগলামিতে তার ভাই কালু অবাক হয়ে বলে- “ভাই, সে হিন্দু, আর তুমি মুসলমান। তোমাদের দুজনের এক হওয়া কিভাবে সম্ভব?" তখন গাজী বলেন- "আল্লাহ অসম্ভবকেও সম্ভব করেন।" কালু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো- "এই ধরনের আবেগ তোমাকে এই মায়াময় জগতের শৃঙ্খলে আটকে রাখবে।" কিন্তু কালুর সহস্র চেষ্টাতেও গাজী তার খোঁজ ছাড়েনি। দীর্ঘ সাত বছর খোঁজার পর দুই ভাই ব্রাহ্মণ নগরের পাশ্ববর্তী নদীর তীরে পৌছালো।
ব্রাহ্মণনগর তবে দেখিলো চক্ষেতে চারিদিকে নদী জল দুগ্ধ-বর্ণ তাতে সোনা দিয়া বাঁধিয়াছে ঘাট চারি খান রাজবাড়ী দেখা যায় অগ্নির সমান দালান মন্দির মঠ সকলি সোনার ঝলমল করে সদা দেখিতে বাহার।
এই ঘটনার আগের রাতে, চম্পাবতী স্বপ্নে দেখে গাজী তার জন্য নদীর তীরে অপেক্ষা করছে। পরের রাতে সে পাঁচজন দাসী, তার নয় খালা এবং সাত শ্যালিকাকে নিয়ে নদীর দিকে যান। সেই রাতে রাহু চন্দ্রকে গ্রাস করেছিল বলে চন্দ্রগ্রহণ ঘটেছিল। কিন্তু গভীর অন্ধকারেও চম্পাবতী ও তার দল নদীর ওপারে লক্ষ চাঁদের আলোর মতো গাজীর দীপ্তি দেখতে পেল। গাজী যখনি তাদের দিকে তাকালেন, তার চোখ চম্পাবতীর কাছে এসে স্থির হয়ে গেল। মুহুর্তে চম্পাবতী এগিয়ে এসে গাজীকে প্রলুব্ধ করার জন্য স্নান করা শুরু করলো।
হাত মাজে পদ মাজে মাজে আর মুখ গাজীকে দেখায়ে মাজে কুচ আর বুক কবরী খুলিয়া কেশ দিলো আউলাইয়া কালো মেঘে চন্দ্র যেন ফেলিল ঢাকিয়া
গাজী বললো- "এখন তোমার বাড়িতে ফিরে যাও প্রিয়তমা, আমরা শীঘ্রই মিলিত হবো।” পরের দিন, ঈশ্বর শিব নিজেই গাজীর সাথে দেখা করেন এবং তাকে আশ্বস্ত করেন যে ভাগ্যের দেবতা বিধাতা তার নিয়তিতে একটি ব্রাহ্মণ মেয়েকে বিয়ে করার কথা লিখেছেন। তিনি কালুকে তার বিয়ের প্রস্তাব মুকুট রাজার কাছে পাঠানোর পরামর্শ দেন। গাজী তার উপদেশ শুনে কালুকে রাজপ্রাসাদে পাঠিয়ে দিলেন। তার প্রস্তাব শুনে রাজা এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন যে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে কালুকে একটি অন্ধকূপে নিক্ষেপ করে তার বুকে একটি বড় পাথর চাপা দেন। যন্ত্রণায় কালু আল্লাহকে স্মরণ করে এবং বারবার ভাইকে ডাকতে থাকে। ঠিক সেই মুহুর্তে, গাজীর পাগড়ি অলৌকিকভাবে তার মাথা থেকে পড়ে যায় এবং সাথে সাথে তিনি বুঝতে পারেন যে কালু বিপদে পড়েছে। তিনি তৎক্ষণাৎ নদীর তীর ছেড়ে সুন্দরবনে চলে যান এবং একটি বড় গাছের গোড়ায় এসে শিঙা বাজাতে লাগলেন। গাজীর ডাক শুনে হাজার হাজার বাঘ ছুটে এসে তাকে সালাম জানায়।
কি হইলো কহ পীর, কহে গাজী কাঁদিয়া কাঁদিয়া যে রূপে গেলেন যথা আদি অন্ত যত কথা শুনাইল সকল ভাঙিয়া ভাঙিয়া বাঘ সবে বলে পীর মন তুমি করো স্থির চিন্তা কিবা আমরা থাকিতে এহি বেলা মোর যাবো আর নাহি জল খাবো চলো বলে সকলেতে।
গাজী বিসমিল্লাহ বলে বাঘের গায়ে ফু দিয়ে তাদেরকে ভেড়ার পালে পরিণত করে নিজে রাখালের ছদ্মবেশে ব্রাহ্মণ নগরের দিকে হাঁটতে থাকেন।এদিকে কালু যে অসহ্য যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল তার সাক্ষী ছিল একটি পরী। পরীটি সঙ্গে সঙ্গে উড়ে গেল তাদের রাণীকে জানাতে। এই খবরে রানী গভীরভাবে ব্যথিত হলেন এবং তিন লক্ষ পরীকে তাদের রথে চড়ে ব্রাহ্মণ নগরে রওনা হওয়ার নির্দেশ দিলেন।
ব্রাহ্মণ নগরের রাস্তায় দুই বাহিনী একত্রে মিলিত হয়। গাজী ভগবান নিরঞ্জনের নাম উচ্চারণ করে তার ভেড়ার দলকে পুনরায় বাঘে পরিণত করেন। ব্রাহ্মণ নগরের প্রজারা প্রাণভয়ে সাহায্যের জন্য তাদের রাজার কাছে ছুটে গেল। রাজা তৎক্ষণাৎ দক্ষিণ রায়কে আদেশ দিলেন ফকিরের মুখোমুখি হওয়ার জন্য।
প্রথমে পড়িল ধুতি আশি হাত দশ-মনি লোহার টুপি দিলেন মাথাত চল্লিশ মনের এক জিঞ্জির কোমরে আটিয়া বাঁধিলো বীর ধুতির উপরে শত-মন খাড়া খানা বগলে লইলো আশি-মন ঢাল আনি গর্দানে বাঁধিলো তিনশো-মনের গদা হাতেতে লইয়া যাত্রা করি যায় বীর সমরে চলিয়া।
গাজীর সেনাবাহিনীর বিশালতা দেখে দক্ষিণ রায় সাহায্যের জন্য নদীর দেবী গঙ্গাদেবীর কাছে প্রার্থনা করেন। দুই প্রেমিকের ভাগ্যলেখা জানার পরেও, দেবী নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ৫২ হাজার কুমির পাঠান দক্ষিণ রায়ের হয়ে লড়াই করার জন্য। কুমিরের শক্ত চামড়া ভেদ করতে গিয়ে গাজীর বাঘের দাঁত ও নখর ভেঙ্গে গেলে, দক্ষিণ রায় বিজয়ের হাসি হাসেন। গাজী তখন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন এবং সূর্যকে এত উজ্জ্বল করে তোলেন যে স্থলে যুদ্ধ করা কুমির সাথে সাথে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। গাজীর বাঘের দল এই সুযোগে দুর্বল কুমিরগুলোকে মেরে ফেলে। দক্ষিণ রায় তখন দেবী গৌরীর কাছে প্রার্থনা করেন এবং ভূত, রাক্ষস এবং পিশাচদের একটি বাহিনী পান। গাজী পালাক্রমে বিসমিল্লাহ পাঠ করে চার দিকে ফুঁ দেন। এর ফলে সমস্ত অশরীরীর মাথা আগুনে জ্বলে উঠে। এভাবে অনেকখন যুদ্ধ চলতে থাকে এবং অবশেষে দক্ষিণ রায়কে গাজীর সামনে মাথা নত করতে হয়। যুদ্ধে তার শক্তিশালী সেনাপতি পরাজিত দেখে রাজা, মুকুটরাজ অবিলম্বে কালুকে মুক্তি দেন এবং তাকে দিয়ে গাজীর কাছে প্রস্তাব পাঠান - রাজার জীবন রক্ষা করলে তিনি ইসলাম গ্রহণ করবেন এবং তার কন্যাকে গাজীর হাতে তুলে দিবেন।
প্রিয় ভাইকে জড়িয়ে ধরে গাজী স্বস্তি অনুভব করেন। তিনি মুকুট রাজের শর্ত মেনে নেন এবং রাজা ও তার সেনাপতির জীবন রক্ষা করেন। অবশেষে, বিধাতার কথা মতো, গাজী ও চম্পাবতী পুনর্মিলন হয় এবং একটি শুভ দিন দেখে তাদের বিবাহ হয়।
প্রথমে সাজায় সবে সাহেব গাজীরে আনিয়া সুগন্ধি তৈল দিলো অঙ্গ পরে আতর গোলাব চুয়া কস্তুরী কুম কুম আর কত পুষ্প তৈল উত্তম অন্তঃপুরে রামাগন সাজায় চম্পারে প্রথমে হরিদ্রা তৈল দিলো অঙ্গ পরে গোলাবের জল দিয়া স্নান করাইয়া দিলেন সুগন্ধি তৈল পশ্চাতে মাখিয়া উচ্চ করে মস্তকে বাঁধিলো লোটন তাহাতে গাঁথিয়া দিলো সেউতি রঙ্গন পরালো কত আর রত্ন অলংকার কোটি শশী যিনি রূপ অঙ্গে জলে যার।