Gule Bakawali

Gule Bakawali

Bengali Title

গুলে বকাওলী (পরিস্থানের ফুল)

Category
Bengali Translation

শর্কস্তানের বাদশা ছিলেন জয়নুল মুলুক। পুত্রভাগ্য ভালো ছিল তার। অন্যান্য রাজা-বাদশার মতো নিঃসন্তান তিনি ছিলেন না। সব ভালোই চলছিল কিন্তু পঞ্চম পুত্র তাজুল মুলুকের বেলায় ভাগ্য বাদ সাধলো। জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, পঞ্চম পুত্রের চেহারা চোখের সামনে এলেই অন্ধ হয়ে যাবেন বাদশা। সময় বারো বছর। বারো বছরের মধ্যেই বাদশাহের কপালে নেমে আসবে এই ঘোর বিপদ।

“কি আশ্চর্য্য কথা এই শুনি নাই শ্রবণে আর পিতা দেখে পুত্র মুখ আন্ধা হয় চক্ষু তার।”

এই ভয়ে বাদশাহ শিশুপুত্র সহ বেগমকে পাঠিয়ে দিলেন প্রাসাদ থেকে বহু দূরে, গহীন জঙ্গলের ধারে একটি আলাদা ঘরে। সেখানে থাকলে আর পুত্রের মুখ দেখতে হবে না তাকে, ফলে অন্ধও হবেন না– এই বুদ্ধিই করেছিলেন তিনি। কিন্তু কথায় আছে, ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডন। তা সে বাদশা হোক বা ফকির, সকলের ক্ষেত্রেই এক। তাই এত সাবধানতায় কাজ হলো না। আগেকার রাজা-বাদশারা তো জঙ্গলে যেতেন বাঘ-হরিণ শিকারে। তেমনি শর্কের বাদশাও একদিন গেলেন মৃগয়াতে। সেখানেই দেখা হয়ে গেল সেই পুত্রের সাথে, যাকে তিনি এতদিন এড়িয়ে চলেছেন। আর ফলে গেল জ্যোতিষীর বাণী। বাদশা হারালেন তার দৃষ্টি। হাকিম-বৈদ্য একখানে হলো, কিন্তু কেউই এর সমাধান খুঁজে পেল না। পরে জানা গেল, অন্য কোনো চিকিৎসা নয়– একমাত্র বকাওলী পরীর উদ্যান থেকে আনা বকাওলী ফুলই পারে বাদশার দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে।

“সেই ফুল ঘষে যদি চক্ষে দেওয়া যায় রওশন হইবে আঁখি জানিবে নিশ্চয়।”

চার বাদশাপুত্র তক্ষুনি অভিযানে বেরিয়ে গেলেন। লক্ষ্য একটাই– যেভাবেই হোক, বকাওলী ফুল যোগাড় করতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে বাবার চোখের আলো। তাজুল মুলুককে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হলো, কিন্তু সেও লস্করবাহিনীর সর্দারের সাথে কথা বলে, গোপনে জুটে গেল এই অভিযানে। পথের মধ্যে বহু নদনদী, বিভিন্ন অঞ্চল পেরিয়ে একদিন ভাইদের এই দল এসে পৌঁছালো ফেরদৌস নগরীতে। ফেরদৌস নগরীতে তাদের দেখা হলো দেলবর লক্ষার সাথে।

“দেলবর লক্ষা বেছওয়া নামেতে রমণী কামের কামিনী ধনি রসে গুনমনী।”

এই রূপজীবী নারীটির প্রেমে পড়ে যায় চার ভাইই। তখন সে ছলে-কৌশলে প্রস্তাব রাখে পাশাখেলার। সে খেলায় প্রায় সকলকেই হারিয়ে দেয় লক্ষা। এবার পঞ্চম ভাই, তাজুল মুলুকের পালা। সে তখন ফেরদৌস নগরের এক আমিরের কাছে চাকরের কাজ করে। বয়সে কম হলেও তাজুল মুলুকের বুদ্ধি ছিল অনেক। দেলবরের বাড়িতে এক বুড়ির সাথে ফন্দি করে সে জেনে নেয় পাশায় জেতার কৌশল। তারপর আমিরের কাছ থেকে ঘোড়া ধার নিয়ে, বেশ সাজগোজ করে তাজুল রওনা দিল দেলবরের মহলে। তাজুল শুধু বুদ্ধিতেই নয়, দেখতেও ছিল অতি রূপবান। তাকে দেখেই দেলবর তাকে মন দিয়ে ফেললো। ওদিকে কথায় কথায় তাজুল তুললো পাশাখেলার কথা। কিন্তু সে যেহেতু আগেই সব জারিজুরি জেনে এসেছে, পাশায় দেলবরকে খুব সহজেই হারিয়ে দিতে পারলো। দেলবরও হার মেনে নিলো তাজুলের কাছে, এরপর তাকে বিয়ের ইচ্ছে জানালো। তাজুলেরও এতে অমত নেই, কিন্তু তার উপরে যে বিশাল দায়িত্ব! সব খুলে বললো দেলবরের কাছে। আর তখনই জানতে পেলো তার গন্তব্যের হদিস–

জমিনের নিচে চৌকি হাজারে হাজারে পরির বাদসার বেটি বকাওলি নাম তাহার বাগিচা সেই শোনো গুনধাম। গোলাবি হাওজ এক আছে বাগানেতে, গোলে বকাওলী আছে সেই হাওজেতে। মানুষের সাধ্য কিবা জাইতে সেথায়, পাখি নাহি পর মারে হাওয়া নাহি জায়।

এই বলে দেলবর অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে চেষ্টা করলো তাজুল মুলুককে থামাতে। কিন্তু তার কাছে তার অভিযানের মূল্য সবচেয়ে বেশি। তাই দেলবরকে শান্ত করে নিজের যাত্রা শুরু করলো নতুন করে। এবারে অন্তত তার কাছে সেই বাগিচার ঠিকানা তো আছে!

পথে এক জঙ্গল পড়লো। সেই জঙ্গলে তাজুলের সাথে দেখা হলো এক দৈত্যের। সেই দৈত্যের সাথে বন্ধুত্ব করে বকাওলী বাগিচার প্রধান প্রহরী হাম্মালা দৈত্যের খোঁজ পেল। তাজুলকে দেখে হাম্মালা এতই খুশি হলো যে মোটামুটি জোর করেই নিজের পালিতা মেয়ে মাহমুদার সাথে তার বিয়ে করিয়ে দিলো। কিন্তু বিয়ে করলে কী হবে, নিজের লক্ষ্য তো আর পূরণ হয়নি। তাই গুলে বকাওলীর কথা ভেবে তাজুল প্রায়ই মন খারাপ করে বসে থাকে। এসব দেখে হাম্মালা তাকে বকাওলী বাগে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলো, “মন খারাপ করে থেকো না জামাই, তোমাকে আমি অবশ্যই বকাওলী বাগ দেখাব!” অতঃপর ডাকা হলো ইঁদুরের সর্দারকে, বলা হলো এমন একটি সুড়ঙ্গ তৈরি করতে– যার মধ্য দিয়ে যেতে পারবে শুধু একজন মানুষ। সেই ইঁদুরের উপরে চড়ে তাজুল গেল সেই উদ্যান দেখতে, যার জন্য সে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে।

“গাছ সব সারি সারি, আছে খাড়া বাগান ভিতরে ভ্রমরা ভ্রমরি আসি, ফুলের উপরে বসি, খায় মধু গুন গুন স্বরে।”

বাগানের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে যখন পাগলপারা তাজুল মুলুক, তখনই তার চোখে পড়লো একখানা গোলাপি মহল। তার মাঝে রয়েছে অতি আশ্চর্য ও সুন্দর এক ফুল গাছ। সেই ফুলের ঘ্রাণে পুরো বাগান গন্ধে ম ম করে, সেই ফুলের সৌন্দর্যে চারপাশ উজ্জ্বল হয়ে যায়। শাহজাদা বুঝতে পারে, এই সেই বকাওলী ফুল, যা তার দরকার। চটজলদি ফুল তুলে নিয়ে কোমরবন্ধনীতে বেঁধে রাখলো সে। কিন্তু সেই সময়েই তার নজর কাড়লো সেই গোলাপি মহলের আরেকটি ঘর। তার ভেতরে ঢুকে তাজুল দেখতে পেলো, সেখানে রাখা আছে একখানা সোনার পালঙ্ক, আর তাতে শুয়ে আছে অতীব রূপসী এক রমণী। এ যেন রূপকথার ঘুমন্ত পুরীর রাজকন্যা। তার রূপেতে ঘর আলোকিত হয়ে আছে, দেখে মনে হয় বেহেশতি নূর। চেহারায় ছড়িয়ে থাকা চাঁদের আলো দেখে তাজুল বুঝতে পারলো, এ-ই তবে পরীদের শাহজাদি বকাওলী। বকাওলীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাজুল যেন ইহকাল-পরকাল সবই হারালো। ফিরবার পথে ভাবলো, নিজের একটি চিহ্ন রেখে যাওয়া দরকার। তাই নিজের হাতের আংটি খুলে রেখে এলো ঘুমন্ত বকাওলীর হাতে। এরপর আবারো ইঁদুরের পিঠে করে সে ফিরে এলো বউর কাছে। কিছুদিন সেখানে কাটানোর পরই ফেরার বুদ্ধি আঁটলো তাজুল। শ্বাশুড়ি, বউ দুজনে মিলে অনেক দুঃখে তাকে বিদায় দিল। আরেক দৈত্যের কাঁধে চড়ে সে পৌঁছে গেল ফেরদৌস নগরে, দেলবর লক্ষার মহলে। সেই যে তাকে কথা দিয়েছিল, মনে আছে? দেলবরের কাছে গিয়ে গিয়ে তাজুল তার চার ভাইকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করলো। তারপর দেলবরকেও পেছনে রেখে সে ফকিরের বেশ নিয়ে এগিয়ে গেল ভাইদের পিছু পিছু। কিন্তু ভাইরা যখন জানতে পারলো, তাজুলের কাছে আছে সেই দুষ্প্রাপ্য বকাওলী ফুল, তখনই তারা তা কেড়ে নিলো। তাদের ইচ্ছা, বাদশার কাছে তারাই হবে ছেলের মতো ছেলে। এই ভেবে ফুল নিয়ে বাদশার কাছে গেল চার শাহজাদা–

“গোলে বকাওলী দিল হাতেতে সাহার ঘষিল সে ফুল সাহা চক্ষের উপর ঘষামাত্র চক্ষু তার রওশন হইল।”

বাদশার চোখ ভালো হয়ে গেছে। এ আনন্দে দেশে সকলে আনন্দ করে, জলসার সুরে সবাই নেচেগেয়ে দিন কাটায়। গরিব-আমির সকলে মিলে এক বছরব্যাপী উৎসবে মেতে ওঠে।

ওদিকে ঘুম ভেঙেছে পরীদের শাহজাদী বকাওলীর। আড়মোড়া ভেঙেই বিবি গেল গোলাপজলে মুখ ধুতে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে তখনই দেখতে পেল, গাছের উপর নেই আর বকাওলী ফুল! নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে, ঘুমের মাঝেই হয়ে গেছে আংটিবদল। কিন্তু কে সে, যে ঘুমের মাঝেই করে গেল ফুল চুরি, সেইসাথে তার মন চুরি? ভেবে লজ্জায় লাল হয়ে যায় বকাওলী।

এক যে বাদশাপুত্র আর এক যে ছিল পরী। শর্কস্তানের বাদশাপুত্র, নাম তাজুল মুলুক, ইন্দ্রসভার নর্তকী যে– পরীর নাম বকাওলী।

পরীদের শাহজাদী বকাওলী পরী বেরিয়ে পড়েছে সেই চোরের সন্ধানে, যে কেড়ে নিয়েছে বাগিচার সবচেয়ে মূল্যবান পুষ্প– গুলে বকাওলী। শুধু ফুল নয়, মন চুরিরও দায় রয়েছে সেই চোরের উপর। তাইতো এত হন্যে হয়ে দেশে-বিদেশে তাকে খুঁজে চলেছে।

উত্তর পশ্চিম আর দক্ষিন দিগেতে বহুত ঢুড়িল যে হর হর জাগাতে ঘরে ঘরে দিবা নিশি খুঁজিয়া বেড়ায় কোনো স্থানে চোরের সন্ধান না পায়।

এভাবেই একদিন পরী ও তার দল যাত্রা করলো পুবের দেশের দিকে। একদিন তারা গিয়ে পৌঁঁছায় শর্কস্থানের ভূমিতে। এই শর্কস্থানেই বাস করে তাজুল মুলুকের পরিবার। শর্কস্থানের সবখানে তখন আনন্দ উৎসব, ঘরে ঘরে চলছে জলসা-নাচগান। এসব দেখে বকাওলী ভাবলো, এইবারে বোধহয় ছদ্মবেশ নেয়াই ভালো। তাই সে ষোল বছরের এক বালকের রূপ নিলো এবং আশেপাশে সকলের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলো, "কীসের এত আয়োজন, জাঁকজমক শহর জুড়ে?" তখন মানুষজন তাকে জানালো বাদশার অন্ধ হবার কথা, এরপর সেই হারানো দৃষ্টি ফিরে পাবার কাহিনি। জানালো গুলে বকাওলী ফুলের জাদুর কথাও। এদিকে জওয়ান রূপেও বকাওলীর সৌন্দর্য কি আর এত সহজে ঢাকা পড়ে? লোকমুখে ছড়িয়ে গেল এই যুবকের রূপের কথা। খবর গিয়ে পৌঁছালো বাদশার ঘরেও। বাদশা খবর দিলেন, “কই সে রূপবান জওয়ান? নিয়ে আসো তাকে সসম্মানে বাদশামহলে।” মহলে পৌঁছানোর পর নতুন নাম নিল বকাওলী, আর মনে মনে ফন্দি আঁটতে থাকলো কীভাবে দেখা মিলবে সেই চোরের। কিন্তু দিনে দিনে দিন যায়, আরামেই কাটে। সেই ব্যক্তির দেখা আর মেলে না। একদিন চার শাহজাদার দেখা পেল বকাওলী, কিন্তু তক্ষুনি সে বুঝতে পারল– বকাওলীর ফুল নিয়ে আসার মতো কঠিন কাজ এদের দ্বারা হয়নি। নিশ্চয়ই আছে অন্য কোনো শাহজাদা। যদিও বাদশার পরিবারের কেউই সে পুত্রের কথা বলে না।

আর তাজুল মুলুক, বকাওলী পুষ্পের আসল চোর, ভাগ্যহত শাহজাদা, মাহমুদা ও দেলবর লক্ষার প্রিয়তম স্বামী, বকাওলী পরীর হারিয়ে যাওয়া দিওয়ানা– কেমন আছে সে? ভাইয়েরা তার হাত থেকে বকাওলী ফুল কেড়ে নিয়ে বাবার চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে এনেছে ঠিকই, কিন্তু তাকে পেছনে ফেলে গেছে। সে তার স্ত্রীদের সাথে সুখে সংসার করলেও মনের মাঝে বড় ব্যথা। রাজ্য হারানোর, পিতা হারানোর– আর ওদিকে মন তো হারিয়েই এসেছে পরীদের শাহজাদীর কাছে। এমন অবস্থায় তার মনে পড়লো, দৈত্যদের দেশ থেকে আসার সময় শ্বাশুড়ি হাম্মালা তাকে তিন গাছি চুল দিয়েছিল। বলেছিল, “যখনই কোনো বিপদে পড়বে, আমার এই চুল আগুনে পোড়াবে। বাতাসেরও আগে সাহায্য পৌঁছে যাবে।” উদাস মনে তাজুল মুলুক আগুনে চুল পোড়ায়, আর ওদিকে শোঁ শোঁ গতিতে এসে দাঁড়ায় আঠারো হাজার দৈত্যের দল– সবার সামনে হাম্মালা। তখন তাজুল মুলুক তার কাছে চায় বকাওলী উদ্যানের মতোই দেখতে আরেকটি বাগিচা। যা হবে হুবহু বকাওলীর আয়না। শাহজাদা নকশা করে দিল, বাকি কাজ করলো দৈত্যরা।

সোনা-রূপা-হীরা-জহরত কিছুই বাকি রাখেনি তারা। এতই সুন্দর করে বানানো হলো নকল বকাওলী বাগ, যে শাহজাদা মুগ্ধ হয়ে গেলো। হাম্মালাকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে তখন সে বহু ধুমধামে তার দুই স্ত্রীকে নিয়ে এলো এই নতুন মহলে। তবে শুধু সংসারেই মন ছিল না তাজুলের। তার মাথায় ছিল অন্য পাঁয়তারা। শর্কস্থানের সব শ্রমিক-কাঠুরেকে দ্বিগুণ টাকা দিয়ে সে নিয়ে এলো নিজের শহরে। বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল বাদশা-উজির সকলেই। এভাবে সবাই নতুন শহরে চলে গেলে তাদের কী হবে? এছাড়া তাজুলের কীর্তির কথা শুনেও তারা বুঝতে পারে না সে আসলে তাদেরই শাহজাদা, যাকে তারা তাড়িয়ে দিয়েছে দেশ থেকে। উজির এসে খবর দেয় তাই বাদশাকে–

“বানাইয়া সোনার জমি বসায় শহর আর এক বাগ বানায় বিচেতে তাহার চৌদিগেতে দিল তার সোনার দিওয়ার আছমান সমান উচা দেখিতে বাহার।”

আর দেরি না করে বাদশা-উজির, শাহজাদা এবং তাদের সাথে জওয়ানরূপী বকাওলী সবাই একসঙ্গে যাত্রা করলো তাজুলের বানানো সেই নতুন শহরে। ঢুকতে না ঢুকতেই যত সব জাদুর কেরামতি দেখে সকলের চোখ কপালে ওঠে। এত আনন্দ, এত উৎসব তো শর্কস্থানেও নেই! বাবার আসার খবর শুনে ওদিকে তাজুল নিজেই এগিয়ে এসেছে সবাইকে স্বাগত জানাতে। সকলকে নিয়ে গেল এবার বিশেষ মহলে, বিশেষভাবে নির্মিত সেই বাগিচায়। বকাওলী তো বিশ্বাসই করতে পারছে না, এমনটাও সম্ভব? কী জাদুবলে এই জাদুকর তার বাগিচা উঠিয়ে এনেছে এইখানে? সাথের এক পরী দাসী ছিল, সে জানালো– “আপনার বাগ আছে আপনা জাগাতে, বানাইলো ঠিকঠাক নকল তাহার।”

এইবার বাবার কাছে চার শাহজাদার জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেল। তাজুল মুলুকের দুঃসাহসিক অভিযানের কথাও সকলের সামনে এলো। সবাই বুঝতে পারলো, তাজুলের জন্যই চোখের আলো ফিরেছে বাদশার। বাদশা জয়নাল মুলুক এতদিনে নিজের ভুল বুঝতে পারলেন, ক্ষমা চাইলেন বেগম ও শাহজাদা দুজনের কাছেই।

এইবারে সকলে যার যার জায়গায়। জয়নাল মুলুক শর্কস্থানে, তাজুল মুলুক তার দুই বিবি নিয়ে বকাওলীর নকল বাগে– আর বকাওলী পরী ফিরে গেল নিজের বাসস্থানে। কিন্তু গল্পের যে আরো বাকি আছে। নটে গাছটি এখনো মোড়ায়নি, গল্পের ডালপালাও এখনো ফুরায়নি। পরীস্থানে গিয়ে মনের দুঃখে, বিরহ অনলে জ্বলে তাজুলকে চিঠি লিখলো বকাওলী–

বিচ্ছেদ বান হানিয়ে বুকে, রহিলে কোথায় তোমার এশকের তোরে বুকেতে লাগিয়া মোরে কলেজা হইলো পার বিষে প্রাণ জায়। তোমার লাগিয়ে মন উড়ু উড়ু সর্ব্বক্ষন। দেখা দিয়ে রাখ প্রাণ ধরি তবো পায়।

আংটিবদলেই হারিয়েছিল বকাওলীর মন। ওদিকে তাজুল মুলুকের এত কীর্তি দেখে মনের পাখি যেন আরো বেশি উড়ে বেড়ায়। পেতে চায়ই তারই দেখা। আর এই চিঠি পেয়ে মুলুক-শাহজাদার অবস্থাও ছিল দেখার মতো। নেভানো আগুন যেন জ্বলে উঠলো দ্বিগুণ। এভাবে কিছুদিন চিঠি আদান-প্রদানের পর একদিন বকাওলী হাম্মালাকে খবর দিয়ে বললো, যেভাবেই হোক তার মেয়েজামাইকে যেন নিয়ে আসে। হাম্মালা কি আর পরীদের শাহজাদীর কথা ফেলতে পারে? হাজার হলেও দৈত্য-পরী সবাই এক কূলেরই লোক। হাম্মালা নিয়ে এলো শাহজাদাকে, শাহজাদীর কাছে– মিলন হলো পরী ও মানুষে। কিন্তু কোনোকালেই এমন মিলন সহজ ছিল না। বকাওলী মা, পরীদের রানি যখন জানতে পারলেন এই কাহিনি– তক্ষুনি তিনি রেগেমেগে জ্বলে উঠলেন তেলে-বেগুনে। বন্দী হলো বকাওলী, চোখের জল ফেলে দিন কাটে তার। ওদিকে তাজুল মুলুককে ফেলে দেয়া হলো সমুদ্রে। ভাসতে ভাসতে সে গিয়ে পৌঁছালো এক কিনারায়, যেখানে অতীব সুন্দর এক ময়দান আছে, আছে এক আলিশান বাগ। গাছে গাছে ঝুলছে বিশাল সব ফল। একেকটি ডালিম যেন কলসির সমান। এসব দেখে যারপরনাই অবাক হলো শাহজাদা।

তার সাথে দেখা হলো বিশালদেহী এক আজদাহা, অর্থাৎ অজগরের। এই অজগর আবার মুখ থেকে ফণার সাথে সাথে মোহর উগলে দেয়। সে মোহরের আলোতে চারদিক আলোকিত হয়। তাজুল পেল এক জাদুকরী বৃক্ষের দেখাও, যার ফল সাথে রাখলে কোনো আঘাত গায়ে লাগবে না– যে বৃক্ষের পাতা কাটা স্থানে দিলে সব ক্ষত সেরে যাবে। এরপর সে খুঁজে পায় এক অদ্ভুত সরোবর, যাতে ডুব দিয়ে রূপ বদলে যায় মানুষের। এমন সরোবরে ডুব দিয়ে রূপ আরো বেড়ে গেল তাজুলেরও। হাতে নিয়ে লাঠি আর মাথার টুপি আকাশে ছেড়ে দিয়ে আশ্চর্য জাদুতে তাজুল মুলুক উড়ে চলে।

লাঠি হাতে লিয়া আর টুপি ছেড়ে দিয়া পশ্চিম তরফে তবে উড়িয়া চলিল জমিন উপরে আর পাও না রাখিল।

পশ্চিম দিকেই তার এখনকার যাত্রা। কেননা সেখানেই তো পরীদের দেশ, তার প্রিয়তমা বকাওলীর বাস। এমন বিভিন্ন তেলেসমাতি কারবারের পর একসময় তাজুলের সাক্ষাৎ হয় রূহ আফজার সাথে। সে বকাওলীর চাচাতো বোন। সকল কাহিনি শুনে রুহ আফজা তাদেরকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেয়। তার চাচী, মানে পরীদের রাণীকেও সে বুঝিয়ে বলে। এমন বহু বাধা-বিপত্তির পর বেশ ধুমধামেই বিয়ে হলো বকাওলী ও তাজুল মুলুকের। কেউ কেউ খুশি ছিল, কারো মুখ ভার– কিন্তু কথায় আছে না, মিঞা-বিবি রাজি, তো কেয়া কারেগা কাজী?

ইন্দ্রসভার নর্তকী, আরেক নামে শাহজাদা শেষ হইলো তাজুল মুলুক আর বকাওলীর কথা।