Husne Banu - A Hatim Tai Tale

Husne Banu - A Hatim Tai Tale

Bengali Title

হুসনে বানু

Category
Bengali Translation

সে বহুকাল আগের কথা। খোরাসান রাজ্যের বাদশা তখন খুরদান শাহ। ঘোড়াশালে তার ছিল পাঁচ লক্ষ ঘোড়া। মহলের আগেপিছে দশ হাজার রথ আর তলোয়ারবাজ, রক্ষী, তীরন্দাজদের ছড়াছড়ি। লোকে বলে, তার রাজ্যে নাকি বাঘে-ভেড়ায় একসাথে জল খায়, এতই ন্যায়পরায়ণ ছিলেন এই বাদশা। রাজ্যজুড়ে শুধু তার সুনাম আর দয়ার কথা ঘুরেফেরে মানুষের মুখে মুখে।

এই খোরাসান রাজ্যেই বাস করতো বারজাখ নামের এক বণিক। বণিকেরও ধন-সম্পদের কোনো অভাব ছিল না। রাজা সে ছিল না বটে, কিন্তু বহু বিষয়ে রাজার মতোই ছিল তার ঠাটবাট। খুরদান শাহের সঙ্গে এই বণিকের ছিল গলায় গলায় ভাব। তাইতো একদিন বণিক যখন মারা গেল, তখন তার আদরের একমাত্র মেয়ে হুসনে বানুর সব দায়িত্ব দিয়ে গেল বাদশাহের উপর। বাদশাহও তাকে নিজ কন্যা বলেই মেনে নিলেন।

হুসনে বানু রূপে-গুণে ছিল অতুলনীয়া। তার জ্ঞানের চর্চার কথা, তার বুদ্ধির কথায় সকলেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বাবা মারা যাওয়ার পর রাজ্যের দায়িত্ব এবার গিয়ে পড়লো হুসনে বানুর উপর। কিন্তু একা মেয়ে, তার আশেপাশে বিয়ে করার জন্য মানুষজনের কমতি নেই। প্রায় দিনই হুসনে বানুকে বিরক্ত করতে চলে আসে শাহজাদা, রাজপুত্র-বণিকপুত্রের দল, কিছুতেই শান্তি নেই তার। তাই হুসনে বানু গিয়ে তার দাইমাকে বললো, “দাইমা, আমি তো এখনই বিয়ে করতে চাই না। আমি ভালোমতো ব্যবসা চালাতে চাই। কী করি বলো তো?” তখন দাইমাকে তাকে হদিস দিলেন সাতটি ধাঁধার। সাথে হুসনে বানুকে সতর্ক করে দিলেন, যদি কেউ এই সাতটি কাজই করতে পারে, তবেই তাকে যেন সে বর হিসেবে মেনে নেয়।

সেই সাতটি প্রশ্ন বা ধাঁধাঁ ছিল–

১. একবার যাকে দেখেছি, তাকে বারবার দেখার বাসনা হয় ২. ভালো কাজ করে তা সাগরে ফেলে দাও ৩. যেমন কর্ম তেমন ফল ৪. সত্যেই শান্তি ৫. যে পাহাড় কথা বলে, সেই কোহিনিদার খবর নিয়ে এসো ৬. হাঁসের ডিমের সমান মুক্তা চাই ৭. ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডন, এই কি সত্যি? না আছে মানুষের শ্রমেরও মূল্য? (অন্য মতান্তরে, “তাকে নিয়ে আসতে বলো বাদ-গার্দের গোসলের হিসাব!)

সেই সাত ধাঁধার ঢাল নিয়ে হুসনে বানুর দিন খারাপ কাটছিল, কারণ কেউই তার সেই ধাঁধার সমাধান কিংবা বলে দেয়া কাজগুলো করতে পারছিল না। এমনই এক দিন হুসনে বানু মহলের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে এক দরবেশকে দেখতে পেল। বাইরে থেকে দেখে দরবেশকে খুবই দয়ালু ও মহান মনে হচ্ছিল, তাই হুসনে বানু তাকে মহলে নিমন্ত্রণ জানালো। কিন্তু আজরাক নামের এই দরবেশরূপী দস্যুর মনের খবর সে জানতো না। এই দরবেশ আসলে চল্লিশ চোরের ওস্তাদ ছিল, যে সে রাতেই হুসনে বানুর মহলে হানা দিয়ে সব ধনসম্পদ লুট করে নিয়ে যায়। পরে হুসনে বানু যখন রাজার কাছে বিচার নিয়ে যায়, কেউ তাকে বিশ্বাস করে না। খোদ রাজাও তাকে নির্বাসনে দেন।

মনের দুঃখে দাইমাকে সঙ্গে করে হুসনে বানু গহীন জঙ্গলের পথে রওনা দেয়। গাছের তলে বসে কাঁদতে কাঁদতে একসময় তারা দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ে এবং স্বপ্নে হুসনে বানুকে দেখা দেয় এক অলৌকিক পুরুষ। সে তাকে জানায়, “প্রিয় হুসনে বানু, তুমি যে গাছের নিচে শুয়ে আছ– সেখানে আছে সাত রাজ্যের ধন! এসবই তোমার। তুমি তা গ্রহণ করো। এই গাছতলায় তুমি গড়ে তোলো এক নতুন শহর।” দৈববাণী শুনে কাঠের টুকরো দিয়ে তারা গাছের নিচে খুঁড়তে শুরু করে। সাথে সাথেই চোখের সামনে উঠে আসে সাত মহলের ধন, যা দিয়ে আরামসে খেয়েবসে কাটিয়ে দেয়া যাবে সাত পুরুষ!

খণ্ড খণ্ড সোনার চাকতি, মণিমুক্তোখচিত সিন্দুক, পেয়ালাভর্তি চুনি-পান্না, হাঁসের ডিমের মতো বড় বড় মুক্তা, কী নেই সেখানে! দৈববাণী অমান্য করলো না হুসনে বানু। তক্ষুনি সে দাইমাকে পাঠিয়ে ডেকে আনলো রাজ্যের বড় বড় কামার-কুমোর, রাজমিস্ত্রীকে।

কিন্তু রাজ্যে নতুন শহর গড়তে হলে যে বাদশার অনুমতি চাই! কে আনবে অনুমতি? হুসনে বানুকে তো তিনি আগেই ভুল বুঝে তাড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সেও হার মানার পাত্রী নয়। বণিকের ছদ্মবেশে, হাতের মুঠোভর্তি চুনি-পান্না আর ঘোড়ার পেছনে সোনার সিন্দুক নিয়ে সে চললো। টগবগে তরুণ এবার সোজা গিয়ে দাঁড়ালো বাদশার দরবারে। বাদশা তাকে দেখেই জানতে চাইলেন পরিচয়– “কে তুমি নওজোয়ান? কী চাই এ রাজ্যে?” হুসনে বানু তখন নিজের পরিচয় দিলো মাহরু শাহ নামের এক ভিনদেশী বণিক হিসেবে। বাদশাহের কাছে উপহার দিয়ে সে তার কাছে বিনিময়ে চাইলো বারজাখ বণিকের বাড়িতে থাকার অনুমতি। বাদশা এমনিতে বড়ই দয়ালু ছিলেন, তাই একটু গড়িমসি করে হলেও তিনি মাহরু শাহকে অনুমতি দিলেন– “বুঝেছো বণিক, ও বাড়িখানা আমার ছেলেরও বড় পছন্দ! কিন্তু চাইছো যেহেতু, যাও থাকো ও বাড়িতেই।”

সেই দরবারে দরবেশ রূপে উপস্থিত ছিল দস্যু আজরাকও। বারজাখের বাড়িতে সে একবার ডাকাতি করেছে। ধরাও পড়েনি। লোভীর মতো লকলক করে উঠলো তার জিভ, দুই চোখে জ্বলছে লোভের আগুন। এই বণিককেও লুটতে হবে! তবে হুসনে বানুও তখন মনে মনে ফন্দি করছে এমন কিছুই। আজরাক সেই ফাঁদে পা দেবে, তার বেশি দেরি নেই!

সেইদিনই মাহরু শাহ (ছদ্মবেশে থাকা হুসনে বানু) তার মহলে ডেকে আনলো দরবেশ ও তার চল্লিশ শিষ্যকে। ভুরিভোজের সময়েই দরবেশ আশপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে নিয়েছে বণিকের ধনরত্ন। আজ রাতেই যে করে হোক, সব সাবাড় করতে হবে! যে-ই ভাবা, সে-ই কাজ। নেমন্তন্ন খেয়ে বাড়ি গিয়ে চল্লিশ সাগরেদকে সব ফন্দি বাতলে দিলো আজরাক, কিন্তু সে জানতো না– একই সময়ে মাহরু শাহও তার রক্ষীদেরকে সতর্ক করে দিচ্ছে, পায়তারা করছে রাজ-কোতোয়ালের সাথে!

রাত্রিবেলা চুপি চুপি বারজাখের মহলে আরো একবার ঢুকে পড়লো আজরাক ও তার চল্লিশ চোর। কিন্তু যে-ই না পেয়ালা থেকে চুনির মালাখানা গলায় পরেছে, সবদিক থেকে ঘেরাও হলো দস্যু দল। পালাবার একটুকু উপায় নেই আর।

পরের দিন সকালে বাদশাহের দরবারে হাজির করা হলো গুনে গুনে চল্লিশ চোর ও তাদের ওস্তাদকে। কিন্তু দরবেশকে এই রূপে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন বাদশা। চোখ কচলে দেখলেন, সত্যি দেখছেন তো? তখন মাহরু শাহ সামনে এসে দরবেশের গলায় থাকা সেই চুনির মালা। সেই একইরকম চুনি মাহরু শাহ বাদশাকেও দিয়েছিল। আর কিছু বুঝতে বাকি থাকলো না কারো। ধরা পড়লো আজরাকের শয়তানি আর দরবেশী সাজ। মাহরু শাহের ছদ্মবেশ থেকে বেরিয়ে আসলো রূপসী হুসনে বানু।

বাদশা তার ভুল বুঝতে পেরে পালক কন্যাকে বুকে টেনে নিলেন। তখন হুসনে বানু বাদশাকে জঙ্গলের সেই গুহা আর তার মধ্যে থাকা ধন-সম্পদের খোঁজ দিল। বাদশাও লোক পাঠালেন সব মণিমুক্তো তুলে আনতে, কিন্তু হায়! বাদশার লোক যখনই গুহার সামনে যায়, মণিমুক্তো-হীরাপান্না সবই উধাও হয়ে ফণি তোলে ফোঁস করে ওঠে বিষধর সাপ! হুসনে বানু এর অর্থ না বুঝলেও বুড়ো বাদশা বুঝলেন। তিনি হুসনে বানুকে ডেকে বললেন, “এ সম্পদে তোমারই অধিকার, কন্যা! এ আর কারো হাতে যাবে না।”

এবার হুসনে বানুর নতুন শহর গড়তে বাদশাও তার সঙ্গী হলেন। শাহী মহল ছেড়ে সাতদিন তিনি হুসনে বানুর সঙ্গে থেকে গড়ে তুললেন নতুন এক মহল। এ মহলে বছরের পর বছর ধরে ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত পথিকেরা ঠাঁই পায়, খাবার পায়। হুসনে বানুর দয়ার কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সকলের চোখের মণি হয়ে হুসনে বানু বাস করতে থাকেন জঙ্গলের মাঝখানে গড়া সেই অলীক শহরে।