রাজা খয়বর জং
বহুকাল আগে, জামপুর নামে এক সুখী রাজ্য ছিল। সেখানকার রাজা প্রজাদের সুখ-দুঃখে সবসময় পাশে থাকতেন। তার শাসনে রাজ্যের প্রতিটি পরিবার সুখী ছিল, আর পুরুষরা তাদের স্ত্রীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করত। কিন্তু রাজা এবং রানীর জীবনে একটাই অপূর্ণতা ছিল—তাদের কোনো সন্তান ছিল না।
একদিন, মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সভার মাঝখানে দুঃসংবাদ এলো—রানী জ্ঞান হারিয়েছেন। সেবা-শুশ্রূষার পর রানী যখন জ্ঞান ফিরে পেলেন, তখন জানালেন এক ভয়ংকর স্বপ্নের কথা। তিনি স্বপ্নে দেখেছেন, এক ভয়ংকর ব্রহ্মদৈত্য তাকে সতর্ক করেছে। দৈত্য জানিয়েছে, প্রাসাদের কাছে এক বিষাক্ত সাপ-ভর্তি পুকুরের গভীরে একটি গোপন কক্ষ রয়েছে। সেই কক্ষে যদি তার পুত্র সন্তানকে বিসর্জন না দেন, তবে রাজ বংশের সবাইকে সে প্রাণে মেরে ফেলবে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দৈত্যকে জানালেন, তার কোনো সন্তান নেই। দৈত্য হেসে উত্তর দিল, "দশ মাস পর তোমার এক পুত্রসন্তান জন্মাবে। তাকে বিসর্জন না দিলে সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী!"
সময় পেরিয়ে দশ মাস পরে, রাজপ্রাসাদে জন্ম নিল এক অপূর্ব পুত্রসন্তান। আনন্দে আত্মহারা রাজা তার নাম রাখলেন খয়বর জং। কিন্তু খুশির দিনগুলো বেশিদিন স্থায়ী হলো না। দৈত্য আবার রানীর স্বপ্নে এসে দাবি করল তার পাওনা।যেহেতু কথা দিয়েছে সেহেতু রাতের আঁধারে, কান্নায় ভেঙে পড়া রানী নিজের হাতে শিশুটিকে সেই ভয়ংকর স্থানে রেখে এলেন। ফিরতি পথে তার চোখের জল কিছুতেই থামছিল না। ৷ সকালে উঠে দেখে দৈত্য তার এই ত্যাগে খুশি হয়ে তার ছেলেকে তার পাশে ফিরিয়ে দিয়ে গেছে৷
আস্তে আস্তে খয়বর জং বড় হতে লাগলো। আর রাজা রানীর বয়স হয়েছে। রাজ্যশাসনের ভার রাজা তার পুত্রের হাতে তুলে দিতে চান।বারো বছরের এই রাজপুত্র ছিল অতুলনীয়—রূপে, গুণে, আর বুদ্ধিতে। কিন্তু তার অন্তরের গহীনে বাস করত এক গভীর ঘৃণা—নারী জাতির প্রতি।
"সব নারীই অসতী," সে বলত। "পুরুষের জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করে তারা।"
রাজা-রানী বহুবার তাকে বিয়ের কথা বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু খয়বর জং সবসময়ই প্রত্যাখ্যান করত। দিন, মাস, বছর পেরোতে লাগল। একদিন রাজসভায় রাজপুত্র ঘোষণা করল,
"আমি বিয়ে করব। কিন্তু আমার শর্ত আছে। কন্যার বয়স হতে হবে ছয় মাস।"
রাজ্যের সবাই হতবাক। এমন শর্তে কোনো মা কি তার সন্তানকে দিতে রাজি হবে? কিন্তু রাজ্যের কেউ এত ছোট দুধের শিশুর সাথে রাজপুত্রের বিবাহ দিতে সম্মত হল না৷ অনেক খোজাখুজির পরে অবশেষে এক দরিদ্র নাজির রাজি হল তার সুন্দরী ছয় মাসের মেয়ের সাথে রাজার ছেলের বিয়ে দিতে৷ রাজা রানী ত মহা খুশি৷ বিয়েতে রাজা সারা রাজ্যের লোকজনকে নিমন্ত্রণ করলেন। সকলের জন্য আহারের ব্যবস্থা করলেন এমনকি নাজিরের বাড়িঘরও রাজা সাজিয়ে দিলেন। মহা ধুমধামে বিবাহ সম্পন্ন করে বউ নিয়ে রাজ বাড়িতে আসলেন সকলে৷
খয়বর জং তার মনের গভীরে এক তীব্র সংশয়ের বোঝা বয়ে বেড়াত। রাজ্যের উৎসবের রাত শেষ হওয়ার পরপরই খয়বর জং মন্দির বানানোর নির্দেশ দিল। মন্দিরের ভেতরে কাঠের সিন্দুক তৈরি হলো। তার ছয় মাসের স্ত্রীকে সেই সিন্দুকে বন্দি করা হলো।একজন সেবিকা ছাড়া আর কারো সেই মন্দিরে যাবার অনুমতি নেই৷ সেবিকা রানীকে খেতে দেয়, তার সাথে খেলাধুলা করে৷ এভাবে দিন কেটে যেতে থাকে৷
কয়েক বছর পর রাজা অসুস্থ হয়ে মৃত্যু বরন করেন। তার কিছু দিন পর রানীও মারা যান৷ ফলে রাজপুত্র খুব বিমর্ষ হয়ে পড়লো৷ কিন্তু রাজ্য ত পরিচালনা করতেই হবে৷ আস্তে আস্তে শোক ভুলে রাজ্য শাসনে মন দিলেন খয়বর জং। দেখতে দেখতে বারো বছর কেটে গেল।
একদিন ঐ রাজ্যে প্রবেশ করলো তিন গুন্ডা৷ তারা জানতে পারল যে রাজা তার রানীকে একটা কাঠের বাক্সের মাঝে রেখে দিয়েছে৷ তারা মনে মনে ফন্দি আঁটে যে এই রানীর সাথে ত দেখা করতেই হবে৷ তারা নিজেরা তখন বড় একটা বাক্স বানায়। তারপর সেই বাক্সে একজন গুন্ডা ঢুকে লুকিয়ে থাকে৷ বাকি দুইজন গুন্ডা রাজার সাথে সাক্ষাৎ করতে চলে যায়। তারা রাজার কাছে এই রাজ্যে ব্যবসা করার অনুমতি চায়৷ রাজা অনুমতি দিলে তারা রাজাকে অনুরোধ করে তাদের কাঠের বাক্সটা নিরাপদ কোন স্থানে লুকিয়ে রাখতে৷ রাজ্যটা তারা ঘুরে দেখতে চায়। রাজা সরল মনে তাদের কথা বিশ্বাস করলেন৷ তিনি কাঠের বাক্সটা রানীকে যে মন্দিরে রাখা আছে সেটার ভিতর রেখে দিল৷ সবাই চলে গেলে বাক্স থেকে গুন্ডা উঁকি দিয়ে রানীকে দেখতে লাগল৷ তার নয়নাভিরাম সৌন্দর্য গুন্ডাকে মুগ্ধ করে ফেলল৷ সে সন্তর্পণে বেরিয়ে আসল রানীর সামনে৷ গুন্ডা তাকে বাক্সের বাইরের জগতের গল্প শোনাত। প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্নণা করত৷ ধীরে ধীরে তাদের দুই জনের মাঝে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল।
অপর দিকে রাজা একদিন ভ্রমণে বের হলেন৷ অনেক দূর যাবার পর তিনি বিশ্রাম নিচ্ছিলেন৷ এমন সময় রাজার সাথে দেখা হল সেই বাকি দুই গুন্ডার সাথে৷ তারা রাজ্য দেখব বলে বের হয়ে আর ফিরে যায়নি। তারা রাজার কাছে নিজেদেরকে গনক বলে পরিচয় দিল। রাজাকে তারা জানাল যে রাজা পিতামাতাহীন। তার এক রানী আছে যাকে তিনি এক মন্দিরে বাক্সে পুরে রেখেছেন৷ তারপর বলল তারা যদি রাজার মনের কথা বলতে পারে তাহলে কি রাজা তাদেরকে রাজ্যের অর্ধেক দান করবে৷ রাজা সম্মতি দিলে ওরা রাজাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে গেল৷ বাড়িতে গিয়ে তারা বলল রাজা বিশ্বাস করেন সব মেয়েরাই খারাপ৷ তারা শুধু ছেলেদের সাথে মিলনে আগ্রহী। রাজা ভীষণ অবাক হয়ে গেল তার মনের সঠিক কথা বলে দিল বলে৷ তারপর গুন্ডারা এক সুন্দরী মেয়েকে পাঠাল রাজার সামনে খাবার পরিবেশ করার জন্য৷ মেয়েটার মিষ্টি হাসি, আড় চোখে তাকানো, মায়াভরা কথা রাজার মনে দোলা দিল৷ রাজা ভাবল এভাবে ত কেউ কোন দিন কথা বলেনি৷ তখন গুন্ডারা রাজাকে বলল যদি ছেলেদের সাথে মিলনের জন্য তিনি মেয়েদের খারাপ ভাবেন তাহলে পৃথিবীর সবাই খারাপ৷ রাজা ভীষণ চিন্তামগ্ন হয়ে গেলেন৷ রাতে ঘুম আসছিল না তার৷ রাজা চুপিচুপি বেড়িয়ে গুন্ডাদের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে সেই মেয়েটি চুলের খোপার ভেতর থেকে একটা কৌটা বের করল৷ তারপর জাদুর বলে সেখান থেকে এক পুরুষ বের হল। তারপর তারা দুজন দহরম-মহরম শুরু করে দিল। এসব দেখে রাজার মনে বোধদয় হল৷ উনি পরদিন রাজ্যে ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিলেন৷ সাথে দুই গুন্ডা আর সেই মেয়েটা৷
রাজ্যে ফিরে এসে মেয়েটিকে তিনি সাত জনের জন্য ভাত রান্না করতে বললেন৷ তারপর মন্দিরের বাক্স থেকে রানীকে বের হতে বললেন। রানী বাইরে এলে রাজা তখন আরেক বাক্স থেকে সেই গুন্ডাকেও বের হতে বললেন। এরপর মন্ত্রীদের হুকুম দিলেন এই চারজনকে জেল খানায় চির দিনের জন্য আটকে রাখতে৷
রাজা বললেন তিনি যখন রানীকে বিবাহ করেছিলেন তখন রানী মাত্র ছয় মাসের শিশু ছিল। তাই তিনি এই রানীকেই পুনরায় বিবাহ করলেন৷ এরপর থেকে রানী শুধু রাজাকেই ভালবাসে। রাজকার্যে রাজাকে সহযোগিতা করে৷ এভাবে রাজা বউ নিয়ে সুখে শান্তিতে বাস করতে থাকে৷