King Manik Pal

King Manik Pal

Bengali Title

মানিক পাল রাজা

Category
Bengali Folktale
Source

সে বহুকাল আগের কথা। উজানী নগরের রাজা ছিল মানিক পাল। ঘরে তার রাজোল নামের রূপবতী রাজকন্যা। রূপকথার রাজকুমারীদের মতো দীঘল চুল আর ঝলমলে রূপ নিয়ে রাজোল দাসীবাসীদের সাথে ভালোই দিন কাটাচ্ছিল। একদিন রাজার মনে হলো, এইবারে রাজকন্যার বিয়ে দেয়া যাক। রাজার কথা, বলতে না বলতে উজির-নাজির সবাই হাজির! রাজা আদেশ দিলেন, “ঢাকঢোল পিটিয়ে সবাইকে বলে দাও- রাজকন্যার বিয়ে দেব, এইখানা কথা লিখে নাও।” রাজন্যার রূপে তো রাজ্যের সকলে মাতোয়ারা, খবরখানা শুনে তাই কেউ খুব একটা দেরি করলো না। পরদিন সকালেই রাজবাড়ির আঙিনা ভরে গেল বিভিন্ন ধরনের যুবকে, এদের সবাই নিজেকে জাহির করতে প্রস্তুত, এদের সবার মনেই একটা আশা- রাজার জামাই হওয়া। রাজকন্যা রাজোল দুইতালা মহল দিয়ে উঁকি দেয়, নাহ, কাউকেই তো মনে ধরছে না। তার রূপের যুগ্যি নয় একটাও তো কুমার। একজনকেও পছন্দ না হওয়ায় প্রিয় দাসীর গলা ধরে বাগানের মাঝখানে বসে রাজকন্যা কাঁদতে লাগলো। জাদুর ময়না পাখিকে ডেকে সে বললো,

“পাকি অ্যাকবার উড়াও দ্যাকিরে

আরে উড়িয়া যায় রে ময়না পাকি।

ছোট্ট হাতে পাইলচোঁ পাকিরে

দুদভাতো খিলিয়া

কোন বা দ্যাশে আচে মোর সোয়ামী

খবর পটে দেও যাহিয়া।”

ময়না পাখি সব খবরই জানে ভালো। সে সোজা জবাব দিল রাজকন্যাকে, যদি যায় মনের মতো বর, তবে খুঁজতে হবে দক্ষিণ মুল্লুকে, এ রাজ্যে তার খোঁজ মিলবে না। দক্ষিণের মুল্লুকে আছে নিচানী নগর, সেখানেই বাস করে রাজোল কুমারীর যোগ্য স্বামী। এই কথা শুনে রাজকন্যা তখনই ময়নাকে পাঠিয়ে দিল সেই নগরে, আর পাখির গলায় বেঁধে দিল নিজের একখানা ছবি। পেট ভরে দুধভাত খেয়ে ময়না উড়ে গেল নিচানী নগরে। দিন নাই, রাত নাই, ময়না উড়ে চলে মাঠে-ঘাটে-জঙ্গলে। এমন করে তিনদিন পর এসে সে পৌঁছলো এক বিশাল উঁচু পাহাড়ে। ময়নার মনে হলো, সে তো রাজকুমারীর হবু বরের চেহারা চেনে না। কী করে জানবে, এত এত লোকের মাঝে কে সেই সুন্দর যুবক? এই না ভেবে ময়না খুব করে কাঁদতে লাগলো। আল্লা-খোদাকে ডেকে সাহায্য চাইলো। খোদা মেহেরবান হলেন। ফেরেশতা জিবরাঈলকে একটি মাছির রূপে তিনি পাঠিয়ে দিলেন জাদুর ময়নার কাছে। ময়না জানতে পারলো অচেনা সেই কুমারের খবর। এরপর আবার শুরু হলো ওড়া। দিন নাই, রাত নাই, ময়না আবারো উড়ে চলে মাঠে-ঘাটে-জঙ্গলে, পাহাড়ে-নদীতে। এমন করে না জানি কতদিন পর সে গিয়ে পৌঁছালো নিচানী নগরে।

নিচানী নগরের রাজা ছিল অনাথ। তিনকূলে তার কেউ নাই, বড় হয়েছে দাইমার কাছে। এক্ষণে রাজার বয়স কুড়ি, তার দাইমা হয়েছে বুড়ি। মনের দুঃখে একা একা বসে রাজা উজিরকে ডেকে বললো,

“বিয়া করা নাইগবে (লাগবে) উজীর

পাত্তুরি উটকিয়া (খুঁজে) দেও মোরে।

নিয়া আইসপেন (আসবেন) সোনদরী কইন্যা

কও বা তোর আগে

ওরে বিয়া না কল্লে মোর এই আইজ্জো (রাজ্য)

কোন কামে নাইগবে।”

এই কথা বলে রাজা বাগানে গিয়ে আকুলি-বিকুলি করে যেই না কাঁদতে বসেছে, তখন সে দেখতে পেল গাছের উপর বসে মিটিমিটি হাসছে এক জাদুর ময়না পাখি। ময়না রাজাকে ডেকে বললো, “আহা রাজা কান্না থামাও! তোমার জন্য সুন্দরী কন্যার খোঁজ নিয়ে এসেছি আমি। মানিক পাল রাজা আছে সেই যে সুদূর দেশে- উজানি নগরে, ওখানকারই রাজকন্যা রাজোল তাহার নাম। দেখবে তারই ছবি তুমি, তাইতো উড়ে আসলাম।” রাজোলের ছবি দেখে রাজার মুখে কথা না সরে। রাজ্যপাট ছেড়ে সে রাজোলের জন্য বৈরাগী হতে চায়। পাখিকে সে বলে, রাজার ছবি নিয়ে আবার রাজোলের কাছে উড়ে যেতে। ময়না আবার দুধভাত খেয়ে, ভালোমতো আরাম করে রাজার ছবি নিয়ে উড়তে উড়তে ছোটে। দিন নাই, রাত নাই, ময়না উড়ে চলে। ওদিকে উজিরের পা ধরে রাজা বলে, “শিগগির চলো উজানী নগরে। সেইখানেতে আমার প্রাণ্যের কন্যা বসত করে!” দেওয়ানের হাতে রাজ্যের সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে উজিরকে সাথে নিয়ে পরের দিনই রাজা রওনা দেয় উজানী নগরের পথে। যাওয়ার সময় প্রজাদেরকে বলে যায়, দেওয়ানকেই এখন থেকে রাজা মানবে। আর যদি কন্যার খবর মেলে, তাহলে সবার পাঁচ বছরের খাজনা মাফ! ওদিকে দেওয়ানকে বলে যায়, প্রজাদের যেন কোনো দুঃখকষ্ট না হয়। নিজের মাথার রত্নমাণিকের মুকুট রাজা দেওয়ানের মাথায় পরিয়ে দেয়। আর নিজে শুধু নেয় সোনার লাগাম মুখে দেয়া ঘোড়া, তাতে রূপার গদি আর তামার ডোরাকাটা সাজোয়া।

বেশ কতদিন ধরে পথ চলার পর রাজা, উজির, ঘোড়া সকলেই ক্লান্ত হয়ে এক জঙ্গলে পড়লো। সঙ্গে টাকাকড়ি, খাবারদাবার কিছুই আনেনি তাড়াহুড়ায়। এই বেলা পেটের খিদায় বাঁচা মুশকিল। পথ চলা বন্ধ করে রাজা-উজির মিলে গাছের তলায় বসে পড়লো। তক্ষুনি তারা দেখতে পেলো, কাছেই এক মালিনী বুড়ি বসে মালা গাঁথছে আর বাড়ির আশপাশের গাছগুলোয় ভরে আছে ফল। রাজা ভাবলো, মালিনীর বাড়িতে বসে আরাম করে খাওয়া-দাওয়া করে আবার রওনা করা যাবে। কিন্তু সে যে-সে মালিনী নয়। দুই অচেনা পুরুষকে বাড়ির দিকে আসতে দেখে সে হাতে দা নিয়ে ছুটে এলো। রাজা তখন দুটি কথা বলে মালিনীকে শান্ত করে জিজ্ঞেস করলো,

ফুলের মাইলেনী সই-

আরে ফুলের ঝুনুরা হে।।

কিবা কামে বসিয়া আচো এই না অঘোর বোনে।

মালিনী তখন এক আশ্চর্য কথা বললো রাজাকে। এই জঙ্গল নাকি পরীদের বাগান, আর এইখানেতেই সপ্তাহ শেষে গুলবাহার নামের এক পরী বেড়াতে আসে। এই মালিনী, সেই পরীরই দাসী।

ওরে পরীস্থানে থাকে পরী

গুলবাহার তার নাম

ওরে সাতদিন বাদ বাদ আসিয়া পরী

এই বাগানোতে বাতাস খান।

সেইসাথে রাজা-উজিরকে মালিনী সাবধান করে দিল, যদি প্রাণের মায়া থাকে, তবে শিগগির এই জঙ্গল থেকে যাতে পালিয়ে যায়। জাদুকরী পরীর বাগানে অযথা কেউ ঘুরে বেড়ালে, তার ক্ষতি করতে সে পিছপা হয় না। কিন্তু রাজার বয়স কম। রক্ত গরম। পরীস্থানের পরীর কথা শুনে তার চক্ষু চড়কগাছ। কী বলে এই মালিনী, পরীকে না দেখে সে কীভাবে চলে যাবে? নাহ, যে করেই হোক রাজার একবার গুলবাহার পরীকে দেখা চাই। তখন সে কায়দা করে মালিনীকে ভালো ভালো কথা বলতে লাগলো। মালিনী তখন আদর করে রাজাকে কোলে নিল, আর রাজাও মালিনীকে মা বলে ডাকতে লাগলো। বুড়িরও ছেলেপুলে নাই, সে অমন কথায় একেবারে গলে গেল। বুড়ি তখন বললো, “আজ থেকে তুমি রাজা আমার ছেলে হলে, দেখি তো কে তোমাকে মারে! যদি আল্লাহ দয়া করেন, তবে এই পরীর সাথেই তোমার বিয়ে দেব, তুমি চুপটি করে বসে থাকো বাছা।” এইনা কথা শুনে রাজা এক নিমেষে ভুলে গেল রাজোলকন্যার কথা। এক এক করে ছয়টি দিন কেটে গেল পরীদের বাগানে। সপ্তম দিনে পরীর আসবার কথা। মালিনী তখন রাজাকে লুকিয়ে রাখলো ফুলের মধ্যে।

পরী এসে প্রথমেই মালিনীর কাছ থেকে ফুলের মালা হাতে নিয়ে গন্ধ শুঁকে মাটিতে ফেলে দিল। “ও মালিনী, এ কেমন মালা গেঁথেছ? এ মালা হাতে নেয়া যায় না, মালা জুড়ে বিশ্রী গন্ধ করে। নতুন মালা গাঁথো।” তখন মালিনী নতুন মালা গেঁথে দেয়। এরপর সন্ধ্যাবেলা সুযোগ বুঝে মালিনী গুলবাহারকে জানায় নিচানী নগরের রাজার কথা, সুন্দর এক আদমের কথা। এ কথা শুনে পরী জোরে জোরে হাসে- “কই আনো দেখি তোমার সুন্দর আদমকে!” রাজাকে আনতেই সে পরীকে দেখে অজ্ঞান হয়ে গেল। আর মালিনী হা-হুতাশ করে বললো, “ছি ছি, পরী হয়ে নবীর বংশের সন্তানকে মেরে ফেললি! তোর কত পাপ হবে, জানিস? এক্ষুনি বাঁচিয়ে তোল আমার ধর্ম-ছেলেকে।” পরী একটু ঝামেলায় পড়লো। টেনেটুনে আদমকে তুললো, তখন সুযোগ পেয়ে রাজা তার গলায় জড়িয়ে ধরে শয়তানি হাসি হেসে বললো, “আদম মতে এই যে হলো তোমার সাথে আমার বিয়ে।” এমন ছলনার শিকার হয়ে গুলবাহার ধারালো এক ছুরি বের করে যেইনা রাজাকে মারতে গেল, তক্ষুনি আবার মালিনী বললো- “ছি ছি, বউ হয়ে নিজের বরকে মারতে চললি! তুই বড় পাপিষ্ঠা, গুলবাহার।” মালিনী বুড়ীর মাথায় কুবুদ্ধি কম ছিল না। গুলবাহারকে চুপচাপ দেখে তখন সে নাকের নথ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলতে থাকলো, “এখন পরী হয়ে তোর গায়ে মানুষের গন্ধ মেখেছে। তুই কি আর পরী সমাজে থাকতে পারবি? ভালোয় ভালোয় এই রাজার ঘর কর, আর নয়তো গলায় দড়ি দিয়ে মর।”

গুলবাহার আর কী করে তখন, সে যায় তার সাথী পরীদের কাছে। সকলেই তার গায়ে মানুষের গন্ধ পেয়ে দূর দূর করে পালিয়ে যায় পরীস্থানে। তখন এ জঙ্গলে মালিনী আর রাজা ছাড়া তার কেউই থাকে না। নিজের ভাগ্য নিয়ে মেনে নিয়ে পরীদের কন্যা তখন মানুষের সঙ্গে সংসার পাতে। ধীরে ধীরে কষ্ট ভুলে সে বেশ সুখে-শান্তিতে দিন কাটায় বৈরাগী রাজার সনে। কিন্তু মনে আছে, সেই যে রাজোল- উজানী নগরের রাজকন্যা? যার জন্য রাজা ঘরবাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছিল, এক রাতে সেই কন্যা আসে রাজার স্বপ্নে...

স্বপ্ন দেখে আদম কেঁদেকেটে গুলবাহারের কাছে বললো,

ওরে শোনেক কইন্যা দুক্কের কথা

ওরে পরাণ মোর ফাটে

বিদ্যায় করিয়া দেহ মোরে

যাইম মুই উজেনী নগরে।

উজানী নগরের কন্যার জন্য আদমের বুক ফেটে যায়। সেই যে তাকে কথা দিয়ে এসেছিল সে জঙ্গলে, তার কথা তো সে ভুলেই গিয়েছিল পরীর সংসারে এসে। এখন স্বপ্নে তাকে দেখে মনের ভ্রম ভেঙে গেল। এখন সে নিজের দায়িত্বের কথা মনে করে বড় ভোগান্তিতে পড়লো। সে পরীকে বললো, “উজানী নগরে আছে এক রাজা- মানিক পাল নাম তার। তার যে কইন্যা রাজোল কুমারী, তারই ছবি দেখে আমি যাচ্ছিলাম সেখানে। তোমারে দেখে ভুলিলাম সব কথা। এখন স্বপ্নে আসি সেই কইন্যা খোঁজে মোরে।”

এই বলে আদম কাঁদতে বসলো হাত-পা ছড়িয়ে। তার ধর্মমাতা মালিনী এসে বললো,

“ওরে খোপা ধরি আনি দেইম মানীক

তোমার পাউয়ের তলে।”

গুলবাহারও বুঝতে পারলো আদমের মনের কথা। তখন পরী আদমকে সাথে নিয়ে আকাশে উড়ে গেল, উজানী নগরের পানে। ঠিক সেই সময়েই জাদুর ময়না পাখি গিয়ে পৌঁছলো রাজোল কুমারীর কাছে। রাজার বাড়িতে ধুমধাম পড়ে গেল। রাজা সবাইকে খবর করে দিল, রাজকন্যার জন্য বর পাওয়া গেছে। ঢুলি ঢোল বাজাতে শুরু করলো। পুরো রাজ্যে সাড়া পড়ে গেল, রাজকন্যার বিয়ে।

রাজোল কুমারী আর আদমের বিয়ে হয়ে গেল। বেশ কিছুদিন পর গুলবাহারের মনে পড়লো তার নিজের রাজ্যের কথা। কতদিন সে পরীস্থানে যায় না। তার বড় মন খারাপ হয়। তার কথা শুনে আদমেরও নিজের রাজ্যের কথা মনে পড়ে যায়। বউকে নিয়ে সে নিজের রাজ্যের পথে রওনা দেয়। মানিক পাল রাজা আর রানী রাজোল কন্যার সঙ্গে থরে থরে দাসী পাঠায়, সাথে যায় হাতি-ঘোড়া-নস্কর। চলার পথে রাজোল বউয়ের নজর পড়ে এক হৃষ্টপুষ্ট আমগাছের দিকে। বরকে ডেকে সে বলে, এই গাছের আম খেতে বড় মন চায়। বর কি তাকে আম পেড়ে দিতে পারে না? আদম তখন বলে, “বাড়িতে গিয়ে অনেকগুলো আম খেও। এখন তা হবার নয়।” তখন নতুন বউ শর্ত দেয়, এই গাছ থেকে আম না পেড়ে দিলে সে যাবে না। এখানেই বসে থাকবে। বারো বছর ধরে রাজোল অপেক্ষা করবে, যদি আম না এনে দেয় এক্ষুনি!

“আম না দিলে তোমার সাতে

যাওয়ার হবার নয়।”

কিন্তু রাজা হয়ে পরের গাছের আম পেড়ে খাবে, এ বড় দুর্নামের কথা। কিন্তু নতুন বউয়ের আবদার, না বুঝিয়ে উপায় কী! তাই সেই আম বাগানের সামনেই রাজাকে তাঁবু গেড়ে বসতে হয়। উজির-নাজির সকলকে ডেকে বলা হয়, এখানেই অপেক্ষা করতে হবে। রাজার বউকে সারাদিন বোঝায়, তবু সে বোঝে না। তখন রানীকে রেখে রাজা রাগ করে চলে গেল নিজের বাড়িতে।

ঠিক এই সময়েই ঘটে আরেক বিকট দুর্ঘটনা। এক দল দেও-দানব এসে রাজার উজিরকে ধরে নিয়ে যায় তাদের দেশে। তখন নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য উজির দেও আর দেওনীর সঙ্গে বসে রাজাকে খাওয়ার মিথ্যে ফন্দি আঁটে। কৈলাশ নগরে বসে তারা আদম রাজাকে মারবার বুদ্ধি করে। রাজাকে খাওয়ার কথা শুনে দেওনী এতই খুশি হয় যে আশি গজ চটের ছালা নিয়ে সে শাড়ি বানাতে বসে, বড় বড় হাতির মাথা এনে নাকে নথ পরে। মরা কুকুরের মাথা দিয়ে কানফুল বানায়। সেই দানবের আবার সুন্দরী নামে এক ভয়ংকর কন্যা ছিল। বয়স তার মাত্র নয় বছর। দেওনী তাকেও সাথে করে নিলো, মানুষ দেখার সাধে। ছয় মাসের রাস্তা ছয় মুহূর্তে পার করে দেওনী মেয়েকে নিয়ে এলো উজিরের কাছে। উজিরকে দেখেই সুন্দরীর মন গলে গেল। সে তাকেই বিয়ে করতে চায়। উজির মনে মনে জিভ কাটে, এই কি ছিল কপালে- শেষমেশ দেওনীর মেয়ের সঙ্গে হবে বিয়ে? কিন্তু প্রাণ বাঁচাতে উজির তাও মানে। দেওনী আর তার মেয়েকে বলে, “সব কথাই মানলাম তোমাদের। এইবার চলো মোর সাথে।”

অনেকখানা পথ হেঁটে দেওনীর ভীষণ খিদে পেয়ে গেল। তখন সে উজিরকে এক বিশাল গাছে চড়িয়ে খাবার খুঁজতে গেল। সেই গাছও সাধারণ গাছ নয়। গাছখানা মানুষের মতোই কথা বলে, মানুষের মতোই জোরে জোরে হাসতে পারে। উজিরকে পেয়ে গাছ তিড়িং বিড়িং করে নেচে উঠলো- নাচতে নাচতে গাছ উজিরকে মাটিতে ফেলে দিল। উজিরকে আর পায় কে তখন, তক্ষুনি এক দৌড়ে সে পৌঁছে গেল উজানী নগরে। ফকিরের রূপ ধরে উজির উজানী নগরে ঘুরে-ফেরে, এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে, যদি রাজার লোক কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়! এইমতো অনেক পথ হেঁটে উজির ফকিরের বেশে রাজমহলে গিয়ে রাজার কাছে ভিক্ষা চায়, কিন্তু রাজা নিজের উজিরকে প্রথমে চিনতে পারে না। উজির তখন দুঃখ করে পুরনো দিনের কথা বলতে থাকে গানে গানে। রাজা তখন উজিরের হাত ধরে ক্ষমা চেয়ে নিজের পাশের সিংহাসনে বসায়। দুজনে মিলে সুখে-শান্তিতে রাজকার্য চালাতে থাকে। উজির আছে ঠিকই রাজার, কিন্তু রানী নাই পাশে। দুই রানী আছে যে রাজার, সে রাজাও থাকে এমন রানীহীন এক সাম্রাজ্যে। এক রানী পরীর দেশে, আরেক রানী তাঁবুতে।

রাজোল কুমারীর উপর রাজার ভীষণ রাগ। একটি বছর কেটে গেল, তবু সে রাজার কোনো কথাই শুনলো না- জেদ করে বসে থাকলো কি না জীর্ণ এক তাঁবুতে! তাহলে রানী নয়, সে দাসীই সই। একখানা বিশাল লোহার ঢেঁকি বানিয়ে রাজা পাঠিয়ে দিল রানীর কাছে। বাইশ মন ওজনের সেই ঢেঁকিতেই ধান ভানতে হবে সকাল থেকে সন্ধ্যাবেলা। এমন কঠিন শাস্তির কথাও শুনেও রাজোল কুমারী কোনো কথা বলে না, চুপচাপ ঢেঁকিতে ধান ভানে আর সকাল-সন্ধ্যা চোখের জল ফেলে। আল্লা-খোদার নাম নিয়ে রাজোল লোহার ঢেঁকিত শোলার বরাবর ধান ভানে। এই দেখে রাজার আরো জেদ চেপে যায়, তেইশ মণ ওজনের কুলা এনে দেয় ধানের কুড়া ঝাড়তে। রাজোলের দোয়ায় তারও ওজন হয় শোলার মতো হালকা। সেই ধান থেকে চাল করে রাজাকে সে ভাত খেতে দেয়। কিন্তু রাজা ভাত খাবে কি- রাগে তার মাথার তালু জ্বলে যায়। তখন সে পঁচিশ মণের ঝাড়ু এনে রাজোলকে ঘর ঝাঁট দিতে বলে। এবারও রাজোল আল্লার কাছে দোয়া করে, কিন্তু বারবার একই জিনিস চাওয়াতে আল্লা তার উপর নাখোশ হলেন। তখন তিনি পঁচিশ মনের ঝাড়ুতে পঞ্চাশ মন ওজন দিলেন, রানী আর ঝাঁট দিতে পারে না। বসে বসে শুধু কাঁদে। রানীর কান্না দেখে রাজার রাগ আরো বেড়ে যায়, কিন্তু তাও রানী কোনো উত্তর দেয় না। তখন রাজা হুকুম দিলেন জল্লাদের কাছে, রানীর মাথা কেটে আনতে হবে। জল্লাদ হলেও তার মনে ভীষণ মায়া। সে বলে,

শোনেক বাশশা আলোমপনা

দয়া হয় মোর মোনে

অ্যামোন সোনদোর আনীক (রানীকে)

কাইটপে কোন জোনে।।

ওরে ক্ষমা যদিকেল চায় আনী (রানী)

ক্ষমা করিয়ায় দিবে।

রাজার ক্ষমা করতে আপত্তি নেই, কিন্তু রাজোল যে কোনো কথাই বলে না। গলায় যেন তার কুরুশ কাঁটা, মুখে যেন তার কুলুপ আঁটা। রাজার রাগ বাড়তে থাকে, সেইসাথে রানীর শাস্তির পরিমাণও। একদিন ছাগল চড়াতে গিয়ে সব ছাগল হারিয়ে ফেলায় রাজা সেই ছাগলের দড়ি মাথায় দিয়ে শীতের রাতে, এক অন্ধকার গর্তের মধ্যে রানীকে ঘুমাতে বলে।

অ্যাকে হইলো ভোকের জ্বালা

তাতে হইলো শীতের কাল

ওরে খুলিতে পড়িয়া অইলো কইন্যা

হয়া তাঁই ব্যাহাল।

ছাগোলের দড়ি মাতাত দিয়া কইন্যা

শুতিয়া নিঁদ বা গ্যালো।

রাজার এমন দুর্ব্যবহার দেখে খোদার আরশও যেন কেঁপে উঠলো। আল্লা তখনই জিবরাইলকে খবর দিলেন, “এক্ষুনি যাও, রাজোল কুমারীর জন্য এক সোনার মহল তৈয়ার করো।” সেই শীতের রাতেই রাজোলের জন্য গড়া হলো সোনার মহল। তাতে রূপার পালঙ্ক, রাজোলের মাথার নিচে মানিকের বালিশ ছড়ানো।

পরের দিন সকালে রাজা এই মহল দেখে একেবারে পাগল হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি রাজোলের পা ধরে বললো, “কে দিয়েছে এই মহল? কে দিয়েছে এই পালঙ্ক? এক্ষুনি বলো নয়তো তোমার অধর্ম হবে।” রাজার ভাবসাব দেখে রাজোল হেসে বললো, “একজন রাজার মুখে এমন কথা মানায় না।” এই কথা শুনে রাজার যেন হুঁশ ফিরলো। সে তখন দাসীদের ডেকে রাজোলকে ভালো ভালো খাবার খেতে দিল। কতই না সোহাগ করলো। সোহাগ করে রাজা আবার জিজ্ঞেস করলো, “এতদিন চুপ করে ছিলে কেন রানী? কী আমার দোষ?” রানী তখন বুঝলো, এই সঠিক সময়।

“এত বড় রাজ্যের রাজা তুমি। কিন্তু সহজ কথা বুঝতে এতদিন লেগে গেল? সেই যে বিয়ের রাতে এই গাছের আম খেতে চেয়েছিলাম, মনে পড়ে? এতগুলো দিন কেটে গেল, মাস-বচ্ছর-দিন। সেই আমখানা তো আমাকে খাওয়ালে না রাজা!”

রাজা তখন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। এক আমের জন্য এত কাহিনী? হায় রে হায়। কতই না ভুল বুঝেছে সে রানীকে। সব রাগ-টাগ ভুলে গিয়ে তক্ষুনি রানীকে ঐ গাছের আম পাড়িয়ে খাওয়ালো রাজা।