কলাবতী কন্যা
বাংলা
নারাণ ছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের তৈলাফাং পরগণার শাসনকর্তা। তার ছিল পাঁচপুত্র। তার মধ্যে চারপুত্রের বউরা ছিল খুবই সুন্দরী ও আকর্ষণীয়। ছোট কুমার ছিল অবিবাহিত। সে ছিলো চার বৌদির আদরের দেবর।একদিন বৌদিরা ঠাট্টা করে বলল- “অলস কুমারের ঘরে কোন মেয়েই আসবে না”। ছোট কুমার তখন বললো- “দেখে নিও, তোমাদের চেয়ে আমার বউ বেশি সুন্দরী হবে”। এই বলে সে গুমচাক ফল (আপেলের মত দেখতে একটি মিষ্টি ও সুঘ্রাণযুক্ত বন্যফল) একটি লাঠি ও একটি ছুরি নিয়ে বউ খুঁজতে বের হয়ে গেলো।
যেতে যেতে কুমারের চোখ পড়লো টং ঘরের রিনাই পরিহিতা অপরূপা সুন্দরী এক কন্যার উপর। সে খোঁপায় বুনোফুল গুঁজে নানা প্রকার গয়না পরে চরকায় সুতা কাটছে। তখন সে টং ঘরের কাছে গিয়ে কন্যাকে উদ্দেশ্য করে বলল
ওহে সুন্দরী পথিক আমি, দিবে আমায় জল? তেষ্টা মেটানোর পুরষ্কারে তুমি, পাবে পূণ্যফল।
মেয়ে: বা! এ ক্যামন কথা। জল দেব না কেন? তুমি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে বস। এই বলে মেয়েটি ফিক করে হেসে টং ঘরের ভেতরে চলে গেল। কিন্তু কুমার দেখলো, কন্যাটি এত সুন্দরী অথচ তার সবগুলো দাঁত পোকায় খাওয়া। এটা তার মন বিষন্নতায় ভরে গেলো। সে আবার বেরিয়ে পড়ল অজানা পথে।
তারপর এক ভিন্ন গ্রামে এসে পৌছাল সে। সেখানে ছোট ঝর্নায় এক যুবতী কন্যাকে সে কলসীতে জল ভরতে দেখলো। রূপার অলংকারে সজ্জিত সেই মেয়ে ছিলো ভীষণ সুন্দরী। কুমার তার বাড়িতে তখন অতিথি হয়ে গেলো। সে মেয়ের বাবাকে তার মনের কথা বললো। কুমারের কথা শুনে বাড়ির লোকেরা খুশি হল। তারা কন্যাটিকে সাজিয়ে গুছিয়ে এনে দেখাল। কিন্তু কুমার দেখলো মেয়েটির চোখ দুটো ট্যারা। পরের দিন সেখান থেকে বিদায় নিলো সে।
ছোট কুমার প্রতিজ্ঞা করলো সুন্দরী বউ সঙ্গে না নিয়ে সে বাড়ি ফিরবে না। হঠাৎ সে একটি কলাবাগানের ভেতর ছোট একটা মাচা ঘর দেখতে পেলো। সেখানে পায়চারী করছে খুব সুন্দরী এক কন্যা। ছোট কুমার থমকে দাঁড়াল। কন্যাও চমকে মুখ তুলে তাকাল। কন্যাটি যেন স্বর্গের অপসরী। ছোট কুমার তাকে ডাক দিলে সে ফুলের বাগানে হারিয়ে যায়। ছোট কুমার আর দেখতে পেল না। তখন সে বাগানের শেষ প্রান্তের যে বাড়িটিতে গিয়ে বললো- আমি একজন ক্লান্ত পথিক। আপনার ঘরে অতিথি হতে চাই। আগামীকাল ভোরে চলে যাব। এ বলে গৃহকর্তার হাতে তার জিনিসপত্র দিয়ে বিশ্রাম করতে লাগল।
ভোরে ছোট কুমার ঘুম থেকে উঠে দেখলো তার জিনিসপত্র বাড়ির লোকেরা নষ্ট করে ফেলেছে। তখন সে তার জিনিসগুলোর বিনিময়ে ওই সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলো। তখন তারা ছোট কুমারের হাতে একটি কলার থোর এনে দিয়ে বলল এ আমাদের একমাত্র কন্যা, নাম কলাবতী। কিন্তু সাবধান। তিনটি ঝর্না পার না হওয়া পর্যন্ত এর পাঁপড়ীগুলো খুলোনা। খুললেই বিপদ হবে।
কলার থোরে ঘুমায় কন্যা কলাবতী নাম তিন ঝর্না না পেরোলে বিপদ সাবধান!
গৃহকর্তার কাছ থেকে কলার থোর হাতে নিয়ে ছোট কুমার বাড়ির দিকে রওয়ানা হল। যেতে যেতে তার কৌতূহল বাড়তে লাগল। সে তিনটি ঝর্না পার না হতেই একটা বট গাছের ছায়ায় বসে কলার থোরের একটা পাঁপড়ী খুলে দেখল। সত্যিই সেখানে কলাবতী কন্যা লুকিয়ে আছে। তার রূপের আলোয় পথঘাট যেন ঝলমল করছে। সে বললো তার খুব তেষ্টা পেয়েছে। কুমার তখন কলাবতী কন্যাকে গাছের নিচে রেখে পানি আনতে নেমে গেল ঝর্নায়। ওই বটগাছে বাস করত এক যাদুকরী ডাইনী বুড়ী। সেও কলাবতীকে দেখেছিল। ছোট কুমার চলে যেতেই ডাইনী বুড়ী গাছ থেকে নীচে নেমে এসে কলাবতী কন্যাকে খেয়ে ফেলল। আর যাদুমন্ত্র বলে কলাবতী কন্যার রূপ ধরে বউ সেজে কলা থোরের মধ্যে লুকিয়ে রইল।ছোট কুমার বাঁশের চোঙ্গায় করে পানি এনে কলাবতী কন্যাকে খাওয়াল। খুব যত্ন করে বাড়িতে নিয়ে গেল। কোন কিছুই সে বুঝতে পারলো না।
বাড়িতে পৌছেই ছোট কুমার সবাইকে তার বউকে দেখাল। বউয়ের রূপের আলোতে বাড়ি ঝলমল হয়ে উঠল। কিছুদিন যেতে না যেতে দেখা দিলো অশান্তি। ছোট বউয়ের গা থেকে বিশ্রী দুর্গন্ধ বের হয়, গালিগালাজ করে, কারো সাথে মিশে না। বাবা তখন ছোট কুমারকে আলাদা একজায়গায় বাড়ি বানিয়ে দিলেন। কুমার দেখল তার বউয়ের কেবল খাই খাই স্বভাব। শুধু মাংসই খেতে চায়। তেল, মসলা ছাড়া প্রায় কাঁচাই রান্না করে খায়। চিন্তায় ছোট কুমার শুকিয়ে যেতে থাকলো।
একদিন সে স্বপ্নে দেখলো যে ঝর্নার পানি কলাবতী খেয়েছিল সেই ঝর্নায় দুটো সোনালী মাছ তাকে ডাকছে। পরের দিন ছোট কুমার ঝর্নায় গিয়ে দেখে সত্যিই সত্যিই দুটো সোনালী মাছ খেলছে সেখানে। ছোট কুমার মাছ দুটোকে আদর করল। এদিকে ডাইনী বুড়ি কুমারকে নজরে রেখেছিল। সে ছোট কুমারের কাছে বায়না ধরল ঝর্নার সেই মাছদুটো খাবার জন্য। ঝর্নার পানি সেঁচে ফেলে সোনালী মাছ দুটোকে ধরে আনল কুমার। আগুনে সেঁকে মাছদুটো টিক্কা বানাল বুড়ি। তারপর ছোট কুমারকে একটা দিয়ে আর একটা নিজে মজা করে খেলো। কিন্তু ছোট কুমার কিছুতেই খেতে পারল না। সে ঘরের উঠানে একটা গর্ত করে সেখানে মাছটাকে পুঁতে রাখলো।
একদিন কুমার দেখল – মাছ পুঁতে রাখা সেই গর্ত থেকে একটা লাউয়ের চারা বেড়ে উঠেছে। বন থেকে বাঁশ কেটে এনে ঘেরা দিল সে। দিনে দিনে লাউ গাছটি বেড়ে ছাদে উঠে গেল। একটা লাউ ধরলো ঘরে ঢোকার রাস্তায় দরজার উপর। লাউটি দেখতে খুবই সুন্দর। কিন্তু ছদ্মবেশী ডাইনী বুড়ি যখনই এর নিচে আসতো লাউটা বুড়ির মাথায় বারি দিতো। বুড়ি খুবই ব্যথা পেত। তা দেখে ছোট কুমারের খুব মজা লাগত। কুমারের নিষেধ ছিল ওই লাউটি কেউ যেন না ছিঁড়ে। বউরূপী ডাইনী বুড়ির সন্দেহ হল লাউয়ের উপর। লাউটা আসলে কী, তা ঘিলা দর্পণে দেখার জন্য বাপের বাড়ি যেতে ছোট কুমারের কাছে বায়না ধরল। কুমারের সম্মতিতে পরদিন চলে গেলো সে। বউ চলে যেতেই কুমারের মন আনন্দে ভরে উঠল। লাউটাকে পেরে শোবার ঘরের সিক্কায় তুলে রাখল সে।
পরদিন কুমার ঘুম থেকে উঠে দেখল, ঘরের জিনিসপত্র সব সাজানো গুছানো। রান্নাঘরে গিয়ে দেখল হাঁড়ি পাতিল ধোয়া মোছা। রান্নাবান্না করা। এসব কাজ করল কে, এর কোনো উত্তর খুঁজে পেলো না কুমার। পরের দিন সে ঘরের সব জিনিসপত্র এলোমেলো করে রেখে রাতে ঘুমাতে গেল এবং ঘুমের ভাণ করে জেগে রইল। মাঝ রাতে সে দেখলো, লাউ থেকে এক সুন্দরী কন্যা বের হলো। কুমার দেখল - এতো তারই বউ। কিন্তু বউ তো বাপের বাড়ি গেছে। তাহলে এ কে? সে চুপ করে ঘুমের ভাণ করে বিছানায় পরে রইল। এদিকে সুন্দরী কন্যাটি ঘর ঝাড় দিতে লাগলো। তখন সে চুপি চুপি পেছন থেকে মেয়েটিকে ঝাপটে ধরল। লাউকন্যা ছিঃ ছিঃ করে উঠল। কুমার তার পরিচয় জানতে চাইলে সে কুমারকে সবকিছু খুলে বললো।
সে বললো, “যখন তুমি আমাকে বটগাছের তলায় রেখে জল আনতে ঝর্ণায় নেমে গেলে। তখন ওই গাছের ডাইনী বুড়ী আমাকে একা পেয়ে খেয়ে ফেলেছিল। খাওয়ার মধ্যে বাকী ছিল আমার দুটো আঙ্গুল। এরই মধ্যে তোমাকে জল নিয়ে আসতে দেখে ডাইনী বুড়ি দুটো আঙ্গুল ঝর্নায় ফেলে দিয়ে আমার রূপ ধরে বউ সেজে বসে রইল। এরপর তোমাকে আমি স্বপ্নে দেখা দিলাম ঝর্নায় যেতে। সোনালী মাছ হয়ে তোমার সাথে খেলা করতাম। কিন্তু ডাইনী বুড়ি এতে সন্দেহ করে তোমাকে দিয়ে আমাকে ধরে এনে টিক্কা বানালো। তুমি নিজেরটা না খেয়ে উঠানে পুঁতে রেখেছিলে বলে আমি লাউ হয়ে জন্ম নিলাম। ডাইনী বুড়ি আমার উপর সন্দেহ করে ঘিলা দর্পণ দেখতে বাপের বাড়ি চলে গেছে। আমাকে যদি তুমি পেতে চাও তাহলে ডাইনী বুড়িকে মেরে ফেলতে হবে। তবে তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি ডাঙ্গায় যেন ডাইনী বুড়িকে মেরোনা। কারণ ডাঙ্গায় এক ফোটা রক্ত পড়লে পুনরায় একজন ডাইনীর জন্ম নেবে। ডাইনী বুড়ীকে ঝর্ণার পানিতে মেরে ফেলতে হবে। ঝর্নার পানিতে আছে অসংখ্য ব্যাঙাচি। আসলে ওরা কেউ ব্যাঙাচি নয়। ওরা বনের নানান জাতের পশু-পাখি। ডাইনী বুড়ি মানুষ শিকার করে যখন রক্ত পান করত, বনের পশু পাখি দেখে বলত আমরা সাক্ষী দেব, আমরা সাক্ষী দেব। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ডাইনী বুড়ি যাদুমন্ত্র বলে তাদেরকে ব্যাঙাচি বানিয়ে রেখেছিল। ব্যাঙাচির দল ডাইনী বুড়ির রক্ত পান করার সাথে সাথে যাদুর প্রভাব মুক্ত হয়ে চলে যাবে। আর ডাইনীর এক ফোটা রক্ত লাউয়ের উপর ছিটিয়ে দিলে আমিও কলাবতী কন্যা হয়ে পুনর্বার আবির্ভূত হব। এর আগে তুমি আমাকে পাবে না”। এইবলে কলাবতী কন্যা লাউ হয়ে গেল।
কলাবতী কন্যার কথা শুনে কুমার দৌড়ে গিয়ে বাপের বাড়ি থেকে একটা চাকু নিয়ে এলো। পরের দিন সকালে ডাইনী বুড়ি এসে লাউ দেখতে না পেয়ে কুমারকে জিজ্ঞেস করল- হ্যাঁ গো, আমাদের লাউটা গেল কই? ছোট কুমার বলল- “লাউটা পেরে তোমার জন্যে তুলে রেখেছি। তুমি ছোট মাছ দিয়ে লাউটা রান্না কর”। কুমার তখন ডাইনী বুড়ীকে নিয়ে ঝর্নায় গেলো। মাছ ধরার ভান করে কুমার সুযোগ খুঁজতে লাগল ডাইনী বুড়িকে মারার জন্য। কিন্তু সুযোগ মেলে না। যেই মারতে যাবে অমনি ডাইনী বুড়ি চেঁচিয়ে উঠে এ্যাই! কি হলো। তুমি আমার উপর চাকু উঠাচ্ছো কেন? ছোট কুমার বললে, আরে কিছু না। তোমার মাথার উপর দিয়ে একটা মাছি উড়ে যাচ্ছিল কিনা, তাই তাড়াচ্ছিলাম। এভাবে ছোট কুমারের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল। সে চাকু দিয়ে কোপ বসিয়ে দিল ডাইনী বুড়ির ঘাড়ে। সঙ্গে সঙ্গে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দিয়ে ডাইনী বুড়ী চিৎকার দিয়ে ডাঙ্গার দিকে ছুটে গেল। ঝর্নার ব্যাঙাচিরা চিৎকার করে বললো- ছোট কুমার, বুড়িকে ঝাপটে ধরো ঝর্নার পানিতে। ডাঙ্গায় যেতে দিও না। ছোট কুমার ডাইনীকে ঝাপটে ধরে চাকু দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপ মেরে ঝর্নার পানিতে ফেলে দিল। আর ব্যাঙাচিরা দলে দলে এসে ডাইনী বুড়ির রক্ত চুষে খেয়ে যাদুর প্রভাব মুক্ত হয়ে শালিক, ঘুঘু, ময়না, টুনটুনি পাখি হয়ে উড়ে গেল। আবার কেউ খরগোশ, শেয়াল, বেজি, হরিণ হয়ে বনে পালিয়ে গেল। ছোট কুমারের চাকুর আগায় ডাইনীর এক ফোটা রক্ত লেগেছিল। ওই রক্ত লাউয়ের উপর ছিটিয়ে দিতেই কলাবতী কন্যা আসলরূপ হয়ে ছোট কুমারকে জড়িয়ে ধরল। ছোট কুমারের মন আনন্দে ভরে উঠল। এরপর তারা সবাই মিলে সুখে শান্তিতে বাস করতে লাগল।