কমল সওদাগর
কর্ণফুলি (স্থানীয় নাম- কাঁইচ্যা) নদীর তীরে ছিল এক শহর- নাম তার বাসন্তী নগর। সেইখানে বাস করতো কমল সওদাগর। বিশাল এক দোতলা দালান, তার আশেপাশে কত না রকমের ফুলে-ফলে ভরা বাগান। সওদাগরের বাড়ির সিংহদ্বারের ঠাটবাট দেখে নগরের সকলের চোখ কপালে উঠতো, এতই তার জৌলুস। সওদাগরের বউ সুরঙ্গিনী ছিল রূপে-গুণে অতুলনীয়া। তাদের ঘর আলো করে ছিল দুই ছেলে- চানমণি আর সূর্যমণি। মায়ের আদরের কোনো কমতি ছিল না সোনার পুত্তুলি ছেলেদের জন্য।
সুরঙ্গনার এক দাসীও ছিল, নাম তার মইফুলা। মইফুলার নিজের কোনো সন্তান ছিল না তাই সে চানমণি সূর্যমণিকে একেবারে নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসতো। মা আর মাসির আদরে সোহাগে বড় হতে থাকলো সওদাগরের ঘরের চাঁদ আর সূর্য। কিন্তু সুখের হয়তো এই দশা যে বেশিদিন স্থায়ী হয় না। তাইতো একদিন অসুখে পড়ে সওদাগরের বউ মারা গেল। বাচ্চা দুটো ঘরের মধ্যে আকুলি-বিকুলি করে কাঁদে, কান্না দেখে বাপের চোখেও জল আসে। ঘরের এহেন দশা দেখে নিজের মনের দুঃখ মনেই রেখে সংসারের সমস্ত ভার তুলে নেয় দাসী মইফুলা, ছেলেদের মাসি মইফুলা। করবে নাইবা কেন, মরার আগে যে তারই হাত ধরে সুরঙ্গনা ছেলেদের দায়িত্ব দিয়ে গেছিলো!
খিদায় ডাকিয়া খাবায়, তিয়াসে দেয় পানি।
দোনো পোলা লই থাকে দিবস রজনী।
তা ঘর নয় কোনোমতে সামলানো গেল। কিন্তু সওদাগরের ব্যবসা-বাণিজ্যের কী হবে? তার বউ ছিল দু পায়ে লক্ষ্মী, তার মৃত্যুর পর আর কিছুই আগের মতো চলে না। কথায় আছে, ‘কপাল যহন ভাঙ্গে তহন ডাঙ্গায় কুমইরে খায়’। সওদাগরেরও সেই হাল এখন। কারবারে লোকসান, জাহাজ ভেসে যায় কালা পানির দরবারে। সুখের সময় সঙ্গে থাকার বহু লোকেই ছিল, এই দুর্দশায় এসে সওদাগর কাউকেই পাশে পায় না। বাড়ির যত চাকর-বাকর-দাসী-খালাসি ছিল, সকলে নিজের মতো বোঁচকা বেঁধে অন্য জায়গায় চাকরি নেয়। সঙ্গে শুধু থাকে ঘরের মাঝে মইফুলা আর দপ্তরেতে গোবর্ধন মুহুরী। সওদাগর তাকে নিজের ভাইয়ের মতোই দেখতো।
মুহুরী একদিন এসে সওদাগরকে প্রস্তাব দেয়, সে যেন বিয়ে করে। বিয়ে করে আবার আগের মতো সংসার গুছিয়ে নিলে তবেই আবার ব্যবসায় ভালো দিন আসবে।
ছারখার হই গেল সোনারই সংসার।।
লাখর সদাইগরী যায় সাইগরে ভাসিয়া।
আমরা হগলে বলি করন আর এক বিয়া।।
প্রথমে বারণ করলেও ঘরের কথা ভেবে সওদাগর রাজি হয়। চারদিকে মুহুরী বিয়ের খবর পৌঁছে দেয়। খবর মেলে, ধর্মপুর গ্রামে এক ধর্মমণি নামে গরীব বণিকের ঘরে আছে সুন্দরী কন্যা। নাম তার সোনাই।
সানাই-বাদ্যি বেজে বিয়ে ঠিকই হলো, কিন্তু সওদাগরের মনে আর আগের রস নাই। নতুন বউর সঙ্গে তার ভাব হয় না। মনের মিল না হয়ে ঘরের অশান্তি আরো বেড়ে চলে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে ব্যবসার লোকসান।
কমল সদাইগর অতি দুঃখে ত পড়িল।।
ট্যাকা পইসা সব তার হইল রে ছারখার।
লক্ষ্মী দেবী ছাড়ি গেলগৈ দেখি অনাচার।।
দশখানি সুলুপ তার ধানর বোঝাই লইয়া।
বার্ষ্যার তুফানে পড়ি গেল যে ডুপিয়া।।
ওদিকে সওদাগরের অজান্তেই সোনাই আর গোবর্ধনের মধ্যে গড়ে উঠলো প্রেমের সম্পর্ক। ঘরে স্বামীর মন না পেয়ে নতুন বউ সোনাই নজর দিল গোবর্ধনের দিকে। গোবর্ধনও কম যায় না, চলনে-বলনে এমনিই সে যেন এক রসের হাঁড়ি। সোনাই যখন নিজের অশান্তির জন্য গোবর্ধনকে দোষ দেয়, তখন সে আর কিছু বলার পায় না। দিনে দিনে চিঠিতে, সাক্ষাতে তাদের মধ্যে প্রেম নতুন বসন্তের মতো ফুল ফোটায়। ঘরের মাঝে থাকা বুড়ো বরকে তখন সোনাইর মনে বিষ ঠেকে। সে চায় সওদাগরের কাছ থেকে মুক্তি। তাইতো সে ফন্দি আঁটে, দূর দেশে পাঠিয়ে দেবে সওদাগরকে, সুখে-শান্তিতে ঘর করবে গোবর্ধনের সাথে। এসব খবর তো আর কমল সওদাগর জানে না, বউয়ের মুখে বাণিজ্যের কথা শুনে সে বোঝে- দেশের লাভে বউয়ের মন ভরে না, তার চাই বৈদেশী কামাই। সাতপাঁচ ভেবে সে গোবর্ধনের হাতে ঘরদোরের সব দায়িত্ব, আর যাবার বেলায় কেঁদেকেটে মইফুলা দাসীর কাছে দুই ছেলেকে তুলে দিয়ে যায়।
সদাইগর চলি গৈলগৈ বাণিজ্যি কামাইবারে
গোবর্ধন ডুপি গেলগৈ সোনাই সাইগরে।।
আর সেই যে মায়ের কোলের আলো, বাপের চোখের মণি চানমণি-সূর্যমণি, তাদের কী হলো? সৎমায়ের জ্বালায় তাদের চোখের পানি নাকের পানি এক হয়। তারা শুধু মইফুলার পেছনে গিয়ে লুকায়। তাদেরকে সোনাই খেতে দেয় শুধু পোড়া ভাত আর বাসি বেগুন। খাওয়া-দাওয়া আর যত্নের অভাবে দুই ছেলের মুখ যায় শুকিয়ে। এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল।
এক রাতে কাজলকোটার ঘরে সোনাই ঘুমিয়ে ছিল। রাত্রেবেলা স্বপ্নে দেখলো, তার সৎ দুই ছেলে রাজা হয়ে গেছে, আর গোবর্ধনের গলায় ঝুলছে ফাঁসির দড়ি। সুরঙ্গনা এসে সেই দড়ি খুলে দিচ্ছে আর সোনাই ভেসে যাচ্ছে সাগরের জলে, যেমন করে ভেসে গেছিল সওদাগরের সকল ডিঙি নৌকা। এমন স্বপ্ন দেখে সোনাই ভয়ে কেঁপে উঠলো। তক্ষুনি সে পাঁয়তারা করলো, যেভাবেই হোক এই দুই ছেলেকে হত্যা করতে হবে। কিন্তু ছেলে দুটোকে যে মইফুলা দাসী নিজের পেটের সন্তানের মতো আগলে রাখে। তাহলে, কী করা যায়? সবার আগে মইফুলাকে রাস্তা থেকে সরাতে হবে। তখন সে মইফুলার সাথে গিয়ে মিথ্যামিথ্যি সখি পাততে গেল।
মইফুলার গালত হাত দিয়া
আদর করি কইল সোনাই
“দিয়ম তর আর এক বিয়া।।”
মনের মতন নাগর তোমার
জোটাই দিয়ম লো আমি।
দাসীপনা ছাড়ি এখন হইবা রাজার রাণী।
সোনাইর কথা শুনে মইফুলার চক্ষু চড়কগাছ। সে ঠিকই বুঝে নিলো শয়তানি বুদ্ধি। সে কিছু না বলে হেসে চলে গেল। পাত্তা না পেয়ে সোনাই তখন অন্য ফন্দি আঁটতে গেল। গ্রামের এক দুষ্ট লোককে এনে সে মইফুলার পেছনে লেলিয়ে দিল। মানিক নামের সেই সর্দার রাতবিরাতে মইফুলাকে এতই জ্বালাতন করলো যে সে আর এই গাঁয়ে টিকতে পারলো না। চানমণি-সূর্যমণির জন্য তার মন কেমন করলেও নিজেকে বাঁচানোও দরকার। তখন সে গা ঢাকা দিয়ে কিছুটা দূরে অপেক্ষা করতে থাকলো, যাতে সোনাইয়ের কুকর্ম ধরতে পারে। সোনাইও তার আসল রূপ দেখাতে দেরি করলো না। সেই রাতেই সে মানিক সদ্দারকে বলে দিল বাচ্চা দুটোকে দূরে কোথাও নিয়ে মেরে ফেলতে। রাত্রে মানিক যখন ঘুমন্ত দুই ফুটফুটে সওদাগরপুত্রকে জঙ্গলের মাঝে নিয়ে মারার জন্য তলোয়ার হাতে নিয়েছে, তখনই কোত্থেকে মইফুলা দাসী ছুটে এসে নিজের বুক পেতে দিল। মইফুলার এমনতর অবস্থা দেখে মানিকের মনে মায়া হলো। তখন সে মইফুলাকে সব কথা খুলে বললো। কেমন করে সোনাই তাকে দুই ছেলেকে মারার জন্য খুঁজে এনেছে, কেমন করে সে মইফুলার পেছনেও তাকে লেলিয়ে দিয়েছিল- কিছুই বাদ দিল না। সব শুনে মইফুলা তখন একটা বুদ্ধি বের করলো।
মানিক সর্দারের হাত থেকে চানমণি-সূর্যমণিকে উদ্ধার করে মইফুলা বেরিয়ে পড়লো এক অজানা পথে। তিনজনে মিলে কোথায় যাবে, কেউ জানে না। শুধু হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে এক জঙ্গলের মধ্যে এসে পড়লো তারা। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে দুই ছেলে গর্জন গাছের নিচে শুয়ে পড়ে।
মাথাত উডে মাথাকঁয়ড়ি গায়ত উডে জ্বর
গাছর তলাত পড়ি তারা করে রে ধড়ফড়।।
কে দিব ওষুদ আর কোথায় ভাত পানি।
পিন্ধনে আছিল কেবল ছিড়া দুইখান কানি।।
বাচ্চা দুই ছেলের এ অবস্থা দেখে মইফুলার বুক ভেসে যায়। কী করে সে তাদেরকে খাবার এনে দিবে, কী করেই বা সারবে অসুখ-জ্বর? একা ফেলে খাবার বা ওষুধের সন্ধানে গেলেও বিশ্বাস কি, চারপাশে অভাব নেই বাঘ-ভালুকের। এমন সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মইফুলা শুনতে পেল, দূরে কোথাও কে যেন গাছ কাটছে। ছুটে সেখানে গিয়ে মইফুলা হাত জোড় করে বললো, “কাঠুরে ভাই, আমার দুই প্রাণের ধন গর্জন গাছের তলায় শুয়ে রয়। গায়ে তাদের ভীষণ জ্বর। ওদেরকে একটু দয়া করে আশ্রয় দাও।” কাঠুরের বয়স কম, মনও নরম। সে এক কথায় বলে উঠলো-
দোনো যাদু লই তুমি চল আমার ঘরে।
কিন্তু ততক্ষণে যা সর্বনাশ হবার হয়ে গেছে। কাঠুরেকে সাথে নিয়ে গর্জন গাছের তলায় এসে মইফুলার চক্ষু চড়কগাছ। হায় হায়, কোথায় চানমণি, কোথায় সূর্যমণি? মাসীর বুক খালি করে কোথায় গেল চলি? মইফুলা আকুলি-বিকুলি করে কাঁদে, ক্ষণে ক্ষণে জ্ঞান হারায়। কাঠুরে যুবক তাকে তখন নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল।
ওদিকে সোনাই বিবি মানিক সর্দারের কোনো খবর না পেয়ে গোবর্ধনকে পাঠালো। গোবর্ধন গিয়ে দেখলো মানিকের হাত-পা বাঁধা, বুকের উপর রাখা আছে এক আড়াইমণি পাথর। মানিককে উদ্ধার করার পর সে শুরু করলো আরেক গল্প, সত্য কথা কিছুই সে মুখ ফসকে বললো না। বলবে কী করে, সোনাই বিবির ভয়ে সে যে থরহরি কম্প! কিন্তু মিথ্যা গল্পে সোনাইর কাছে চিড়ে ভিজলো না। সে ঠিকই বুঝতে পারলো আসল কাহিনী। মানিক সর্দারও সুযোগ বুঝে সেখান থেকে চম্পট দিল, তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। তখন সোনাই গোবর্ধনকে পাঠিয়ে দিল মইফুলা দাসীর সন্ধানে।
ওদিকে মইফুলা কাঠুরের বাড়িতেই থাকে, দুই ছেলের শোকে কাতর হয়ে তার দিন কাটে। ঘুমের মধ্যে কেঁদে কেঁদে ওঠে সে- ও চানমণি, বাবা সূর্যমণি! আসলে হয়েছিল কি- যখন মইফুলা কাঠুরেকে খুঁজতে গেছিল, তখনই ঘুম ভেঙে যায় দুই ছেলের। জলের তিয়াসে অস্থির দুই ভাই জঙ্গলের মাঝে ঘুরে বেড়াতে থাকে। একখানা পাহাড়ি ঝর্ণা পায়ও বটে, আর সেই জাদুকরী ঝর্ণার জল খেয়ে দুজনেরই জ্বর ছেড়ে যায়। এরপর শুরু হয় ভাতের খিদা। সে কি যে সে খিদা, যেন পেটের মধ্যে আগুন জ্বলে। ক্ষুধায় দিশাহারা হয়ে দুজনেই পথ হারায়, কোনোমতেই তারা আর সেই গর্জন গাছের তলা খুঁজে পায় না। কয়েকদিন ধরে তারা জঙ্গলেই ঘুরে বেড়ালো। ফলমূল যা পায়, তা খায় আর দু ভাই মিলে দুঃখ করে এই গাছ, সেই গাছের তলায় রাত্তিরে শুয়ে পড়ে। এমনি দিন যাচ্ছিল, তবে একদিন সকালবেলা এক আচানক ঘটনা ঘটলো। কোত্থেকে যেন এক বিশাল শ্বেত হাতি হুড়মুড় করে এলো আর চানমণিকে শুঁড় হেলিয়ে দুলিয়ে নিজের পিঠে তুলে নিল। সে হাতির পিঠে ছিল এক মস্ত সিংহাসন, সেখানেই সে সওদাগরপুত্রকে বসিয়ে এক নিমেষে জঙ্গলের আরো ভেতরে পালিয়ে গেল। ঘুম ভেঙে সূর্যমণি ভাইকে কোথাও খুঁজে পেল না। এতদিন ছিল দুই দুঃখী ভাই, এখন সে যে শুধু একাই!
দক্ষিণ দেশে ছিল এক পাহাড়ি মুল্লুক। সে মুল্লুকের রাজা যখন মারা গেল, তার কোনো ওয়ারিশ ছিল না। তখন প্রজারা সবাই মিলে রাজ্যকে অতিষ্ঠ করে তুললো।
রাজা ত মরি গেলগৈ পুত্র কইন্যা নাই।।
দাবিদার অনেক হইল সিঙ্গাসনের লাই।।
রাজার দোষে রাইজ্য নষ্ট পরজা কষ্ট পায়।
কে হইব রাইজ্যর রাজা ভাবি দেখহ উপায়।।
সোনা রূপা নষ্ট জাইন্য তামা আর পিতলে।
রাজা নষ্ট অবিচারে মধু নষ্ট জলে।
সাতপাঁচ ভেবে তখন উজির ঘোষণা দিল, “আছে যে এক ধলা হাতি, থাকে পিল খানাতে। যে সে হাতি নয় সে, জানে ভূত-ভবিষ্যতের কথা। সেই হাতিই ঠিক করবে, কে হবে এই রাজ্যের রাজা।” ধলা হাতি দেশ-দেশান্তর ঘুরে গিয়ে হাজির হলো চানমণির সামনে। কেননা জন্মের পরই তার কপালে আঁকা ছিল এক রাজতিলক। কেউ সে তিলক দেখতে না পেলেও শ্বেত রাজহস্তির চোখ এড়ায়নি তা। কপালের লেখা ফলে গেল, চানমণি রাজা হলো। কিন্তু হায়, কোথায় পাবে তার ভাইকে? লোক-লস্কর পাঠিয়েও খোঁজ মিললো না সূর্যমণির। চিন্তায় চিন্তায় রাজার রাতের ঘুম হারাম হয়। ওদিকে ভাইয়ের জন্য কেঁদেকেটে সূর্যমণির চোখের জলে পাহাড়ি জলার জল বেড়ে যায়। সেই জলে ভেসে আসে বাঁশ ব্যবসায়ীর দল। সূর্যমণিকে দেখে তারা নিজেদের চালায় তুলে নেয়।
বাঁশ বিক্রেতার সেই দল নৌকা নিয়ে পৌঁছে যায় রাজদরিয়ার ঘাটে। এই ঘাটেরও মালিক সেই অদ্ভুত দেশের রাজা তার নিজেরই ভাই, যদিও সূর্যমণি সে খবর জানে না। সেই ঘাটে বাঁধা ছিল এক সওদাগরের চৌদ্দ ডিঙা। যে রাতে সূর্যমণি বণিকের দলের সাথে ঘাটে পৌঁছাল, সে রাতেই সওদাগর স্বপ্নে দেখলো- সমুদ্রের দেবতা একজন মানুষ বলি চায়! এরপর ঘুম থেকে উঠে সওদাগর এক হাজার টাকার তোড়া হাতে নিয়ে বসে থাকে।
“দেবতার ভোগের লাগি মানুষ একডা চাই।
কনে বেচিব মানুষ হাজার ট্যাকার লাই।।
এই কথা শুনে বাঁশ ব্যাপারি তাড়াতাড়ি সূর্যমণিকে বেচে দিল সওদাগরের কাছে। আর হাজার টাকার তোড়া নিয়ে দলবল নিয়ে পালালো। সূর্যমণির দিকে তারা ফিরেও তাকালো না। আর সওদাগরের মানুষজন তাকে সাজিয়ে-পরিয়ে, খাইয়ে-দাইয়ে প্রস্তুত করলো। হাত-পা ভালো করে বেধে তারা মাঝসমুদ্রে নিয়ে বেচারা ছেলেটাকে ফেলে দিলো।
এক ঢেউ তুলে যাদুরে আশমান বরাবর
আর ঢেউ তুলি দিল ঠাডা বালুর চর।।
চরের কাছে আছিল এক মাছ-বেচনীর ঘর।।
পরভাতে আইল নারী সেইনা বালুর চল।
সূর্যমণিকে দেখে সেই মাছ-বেচনীর বড়ই মায়া হলো। তাড়াতাড়ি সে তাকে নিয়ে গেল নিজের বাড়িতে। তার সেবা-শুশ্রূষা করলো। এভাবেই সওদাগরের এক ছেলে হলো রাজা, আরেকজন এসে পড়লো মাছ বিক্রেতার ঘরে। দুই ভাইয়ের কেউই সুখে নাই, একে অপরের কথা মনে করে খালি চোখের জল ফেলে।
সুখ নো থাকিলে মনে রাইজ্য কিবা ছার,
পরমান্ন কি ভালা লাগে পেডর অসুখ যার।।
দুই ছেলের যখন এমন দুর্দশা, তখন তাদের বাপ কমল সওদাগর তার বারো বছরের বাণিজ্য শেষ করে রাজদরিয়ার ঘাটে ডিঙা ভেড়াচ্ছে। বেশ কয়দিন সময় গেল ঘাটে নোঙর ফেলতে। এরই মাঝে আশপাশের লোকজনের সাথে দেখা হলো, দেখতে পেল এক সোনার বরণ ছেলে বাস করে মাছ-বেচনীর ঘরে। সেই ছেলেকে দেখে সওদাগর নিজের ছেলের কথা মনে করে। কপালের এমন লিখন, বাপ ছেলেকে চিনতে না পারে।
এমন এক সময় ঘাটোয়াল এসে খবর দিল, নৌকা ছাড়া যাবে না সওদাগরের। হাজার টাকা দিলেও না। খোদ রাজা এসে দেখা করবেন সওদাগরের সাথে। সওদাগর তো ভয়ে কাবু, কী কাজ করে সে রাজার চক্ষুশূল হয়েছে? কী তার দোষ? তখনই দেখে রাজমুকুট ঝলমল করে এক সোনার পুত্তুর দৌড়ে এসে তাকে বাবা বলে ডাকছে।
নয়া রাজা যাই পড়ে সদাইগরর পায়।
‘বাবা, বাবা’ বলি ডাকি আরে পরাণ জুড়ায়।।
চানমণিকে দেখে সওদাগরের চোখ খুলে গেল। তাহলে মাছ-বেচনীর ঘরের সেই অচেনা ছেলেটিও তারই আরেক পুত্র সূর্যমণি! ভাইয়ে ভাইয়ে মিলন হলো। ছেলেকে বাপে চিনতে পারলো। দুই ভাই মিলে বারো বছর পর বাপের দেখা পেয়ে সকল দুঃখের কথা বলে, জানতে চায়, কী হলো মইফুলা মাসীর- কী হলো তাদের ঘরবাড়ির। বাপ-ছেলেরা মিলে সাততাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে গেল, গিয়ে দেখে সোনাই সেখানে রানী হয়ে বসে আছে। কোথাও মইফুলার খোঁজ নেই। সবাই বললো, সে দাসী তো কবেই মরেছে! এই না কথা শুনে সওদাগর সোনাইয়ের চুল ধরে তাকে মাঝ দরিয়ায় নিয়ে কালা পানির মধ্যে ফেলে দিলো। গোবর্ধন আর মানিক তো আগেই পালিয়েছে।
এরপর চানমণি তার ভাইকে সাথে নিয়ে মনের সুখে রাজত্ব করে। সওদাগরও বাণিজ্য শেষে ছেলের রাজ্যে আরাম করে। প্রজারাও নতুন রাজাকে পেয়ে ভীষণ খুশি। এভাবে ভালোই কেটে যাচ্ছিল দিন। একদিন হঠাৎ করে রাজদরবারে দেখা গেল এক পাগলিনীকে। গানের কথায় কথায় সে বলে সৎমায়ের অত্যাচারের কথা, দুই সোনার পুত্তুলি ভাইয়ের কথা।দুই রাজা তাকে দেখে দৌড়ে গিয়ে বলে, ‘মইফুলা মাসি!’ কিন্তু সে পাগলিনী কিছুই বোঝে না। শুধু দুই চোখের জল ফেলে, প্রাসাদের এককোণে পড়ে নিজের অভাগা জীবনের কথা ভাবে আর গান গায় বারোমাসি।