বহুদিন ধরে আরবের রাজার মনে কষ্ট। আজ পর্যন্ত প্রজাদের জন্য তিনি কম করেননি, রাজা হিসেবে নিজের দায়িত্বও ঠিকভাবে পালন করেছেন। কিন্তু তার ঘরে কোনো সন্তান নেই। রাজা ঠিক করলেন, তিনি জঙ্গলে চলে যাবেন। কিন্তু বিশ্বস্ত মন্ত্রী রাজাকে থামালেন।
সে রাজ্যেরই এক বণিক– আজিজ সওদাগরের ঘরে এর ঠিক চার বছর পরে জন্ম নিলো সেই ভুবনমোহিনী কন্যা, যার নাম লাইলি। লাইলি ও কয়েস একইসঙ্গে পাঠশালায় পড়তো, পাঠশালায় পুঁথি আদান-প্রদান, একসঙ্গে পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের মধ্যে গড়ে উঠলো এক বন্ধুত্বের গল্প। তারা যত বড় হতে থাকলো, ধীরে ধীরে সেই বন্ধুত্ব প্রেমে রূপ নিলো– সে কথা তারা দুইজন ছাড়া আর কেউই জানতে পেলো না।
কিন্তু এমন কথা কি আর লুকানো থাকে? কয়েসের বয়স তখন ১৮, লাইলি সবে চোদ্দতে পা দিয়েছে। রাজবাড়ির ছেলের সাথে মেয়ের চলাফেরা ভালো লাগলো না লাইলির মায়ের, তিনি তার পড়ালেখাই বন্ধ করে দিলেন। ওদিকে দিনের পর দিন কয়েস অপেক্ষা করে, কবে আসবে লাইলি? লাইলিও না খেয়ে, না ঘুমিয়ে দিন কাটাতে থাকে। লাইলির অপেক্ষায় কয়েস পাগলপ্রায় হয়ে যায়, রাজবেশ ছেড়ে, পাঠশালার পড়া বাদ দিয়ে সে পথে পথে ঘুরতে থাকে ফকিরের মতো। লোকে তাকে নাম দেয়, লাইলির– মজনু। মজনু ফকির হয়ে লাইলির বাড়ি ভিক্ষা নিতে যায়, সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে লাইলি তাকে ভিক্ষা দেয়। দিনে একবার লাইলিকে চোখের দেখা দেখেই মজনু খুশি থাকে। কিন্তু একদিন এই বিষয়টিও নজরে পড়ে গেল লাইলির মায়ের, তিনি আদেশ জারি করলেন– “ আজ হতে পর্দার বাইরে যাওয়া বারণ! ফকিরকে ভিক্ষা দিয়ে তোমার আর কাজ নেই।” আবারো যে-ই, সে-ই। লাইলি-মজনুর বিরহে গাছের পাতা ঝরে পড়ে, কেঁদে উড়ে যায় বনের পাখি।
“মজনু, তোমার কাঁদন শুনিয়া মরু-নদী পর্বতে বন্দিনী আজ ভেঙেছে পিঞ্জর বাহির হয়েছে পথে”
ওদিকে মজনুর ঘরে তখন সবাই শোকে কাতর। বৃদ্ধ রাজা কোনো উপায় খুঁজে পান না, রানি কেঁদে অস্থির। খবর নিয়ে তারা জানতে পেলেন, তাদের আদরের সম্বল এখন জঙ্গলে গাছের নিচে দিন কাটায়। রাজা ছেলের খোঁজে গেলেন। কিন্তু ছেলে বাবাকেও চিনতে পারলো না, তার মুখে শুধু একটাই নাম– “লাইলি, লাইলি!” রাজা তখন ছল করলেন। ছেলেকে তিনি বললেন, “মজনু, তোমার জন্য লাইলি অপেক্ষা করে আছে। তুমি আমার সাথে চলো।” মজনু তখন পাগলের মতো রাজার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলো। রাজবাড়িতে গিয়েও মজনুর অবস্থার কোনো বদল হলো না। এদিক-ওদিক সে শুধু লাইলিকেই খোঁজে। তখন এক লোক এসে রাজাকে খবর দিল, রাজ্যে এক তপস্বী এসেছেন। তিনি সিদ্ধপুরুষ। তিনি নিশ্চয়ই মজনুকে ভালো করে তুলবেন!
তপস্বী রাজাকে এক অদ্ভুত চিকিৎসার কথা বললেন, “শুনুন রাজা। মজনু যে লাইলির জন্য পাগল হয়েছে, সেই লাইলিই এর চিকিৎসা। লাইলির হাতে কাটা সুতা এনে আপনি মজনুর পোশাক বানিয়ে দিন, তাহলেই সে আর তার কাপড় ছিঁড়বে না। লাইলির ঘরের মাটি এনে মজনুর চোখে লাগিয়ে দিন, তাহলেই মজনু আর পাগলের মতো কাঁদবে না।” বলা বাহুল্য, এই চিকিৎসায় মজনুর পাগলামি অনেকটাই কমে গেল। রাজাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তখন রাজা ঠিক করলেন, যদি লাইলির মাঝেই তার ছেলের সুখ, তার সঙ্গেই মজনুর বিয়ে দেবেন। সওদাগরের কাছে বিয়ের প্রস্তাব গেল, রাজা নিজ হাতে শত উপহার, মণি-মাণিক রেখে বললেন, “ভাই, কয়েসের সাথে লাইলির বিয়ে দিতে চাই। তুমি কী বলো?” সওদাগর তখন ইতস্তত করে উত্তর দিলেন, “মহারাজ, এ আমার বিশাল সৌভাগ্য! কিন্তু মেয়ের দিকটাও তো দেখতে হয়। লোকে বলে, কয়েস পাগল! সে এখন মজনু! জেনেশুনে এমন ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দেব, এও কি সম্ভব?” রাজা তখন সওদাগরকে অভয় দিয়ে বললেন যে কয়েস এখন ভালো হয়ে গেছে। সওদাগরকে এর প্রমাণ দিতে তিনি রাজসভায় মজনুকে ডেকে নিয়ে এলেন। প্রথমে মজনু বেশ শান্তই থাকলো, কেননা তার পরনে আছে লাইলির স্পর্শযুক্ত পোশাক ও মাটি। কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস, তখনই কোত্থেকে যেন একটি কুকুরছানা এসে দাঁড়ালো রাজসভায়। আর কেউ একজন মজনুর কানে কানে বললো, “কুকুর কিন্তু লাইলির খুব প্রিয়!” ওমনি মজনু রাজ আসন ছেড়ে দিয়ে ধুলায় লুটোপুটি খেয়ে কুকুরটির সাথে খেলতে লাগলো। দেখে মনে হলো, এ যেন রাজপুত্র নয়– অবোধ কোনো শিশু! লাইলির বাবা তখন হতাশ হয়ে রাজার দিকে তাকিয়ে সভা ছেড়ে চলে গেলেন। বিয়েও আর হলো না।
লাইলিও ঘরের মধ্যে শুধু মজনুর কথাই বলে, মজনুর নামে কাঁদে– অন্য কোনোদিকে তার খেয়াল নেই। লাইলির মা ভীষণ খেপে গেলেন। তিনি তখন দূরদেশের এক রাজপুত্রের সঙ্গে লাইলির বিয়ে ঠিক করলেন। ইচ্ছার বিরুদ্ধে লাইলির বিয়ে হলো ঠিকই কিন্তু তিনি নতুন বরকে মেনে নিলেন না, ফিরিয়ে দিলেন। নিজে রয়ে গেলেন মা-বাবার বাড়িতেই। আশপাশের সবাই লাইলিকে যাচ্ছেতাই কথা বলতে লাগলো, কেউই তার সাথে ভালো করে কথা বলে না আর। লাইলির তাতেও যেন কিছুই যায়-আসে না। শোকে পাথর হয়ে লাইলি বসে থাকে। কখনো কাঁদে, কখনো মজনুর কল্পনায় ভাসে।
সে রাজ্যে বাস করতো এক মায়াবিনী-ডাকিনী। মেয়ের পাগলামি দেখে সওদাগর তখন ঠিক করলেন, সেই মায়াবিনীর সাহায্য নেবেন। মায়াবিনীটি ছিল এক বৃদ্ধা, যাকে দেখে প্রথমেই যে কারো মনে মায়ার জন্ম হবে। সওদাগরের কথায় মায়াবিনী গেল মজনুর কাছে, বনের মাঝে। মজনুর কাছে সে লাইলির নামে বহু মিথ্যা বললো। বললো, লাইলি নতুন সংসারে বড় সুখে আছে। মজনুর কথা হয়তো তার মনেই নেই। সব শুনে মনের কষ্টে মজনু তখন যারপরনাই রাগে-দুঃখে লাইলিকে একটি চিঠি লিখে বুড়ির হাতে দিল। বুড়ি তখন মিথ্যে মিথ্যে দুঃখ দেখিয়ে লাইলির কাছে চিঠি দিয়ে তখন মজনুর নামে খারাপ কথা বললো। লাইলিও তখন চিঠির জবাব লিখতে বসলো। কিন্তু কলম কাটতে গিয়ে লাইলির হাতের আঙুল গেল কেটে, সেই রক্তঝরা আঙুল দিয়েই লাইলি চিঠি লিখলো। ওদিকে একই দুখের ভাগীদার, বনবাসী মজনুর হাত থেকেও তখন রক্ত ঝরতে লাগলো। সেই চিঠি পড়ে মজনু ছুটে এলেন লাইলির কাছে, ফকিরের বেশে। দুয়ে আবার ক্ষণিকের জন্য মিলন হলো। ভুল বোঝাবুঝি শেষ হলো। মায়াবিনীর মায়াও তাদের প্রেমের কাছে হার মেনে গেলো। কিন্তু সমাজ-সংসার বড় নিষ্ঠুর, মজনু কি আর বিবাহিত লাইলির কাছে থাকতে পারেন? তাকে আবার ফিরে যেতে হলো সেই বনে, পাখি ও গাছের কাছে। আর সেখানে তার একদিন দেখা হলো সেই রাজপুত্রের সাথে, যে ধর্মমতে লাইলির স্বামী। রাজপুত্র আসলে মজনুকেই দেখতে এসেছিল, তার জানার বড় ইচ্ছা ছিল– কে সে পুরুষ? যার জন্য বিয়ে করা বউ তাকে ফিরিয়ে দিল? এমনই দুঃখ, যে নববধূর মুখটিও দেখতে পারেনি রাজপুত্র। কিন্তু মজনুর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পর রাজপুত্রের মন গলে গেলো। সে মজনুকে কথা দিল, যে করেই হোক লাইলি-মজনুর মিলন সে করিয়ে দেবে। তার জন্য লাইলির বাবা-মায়ের সাথে যুদ্ধ করতে হলেও সে রাজি! সওদাগরের বাড়িতে হানা দিয়ে রাজপুত্র পাইক-বরকন্দাজ নিয়ে লাইলিকে তুলে আনতে গেলো, মজনুর জন্য। কিন্তু তারও মন তখন টলোমলো। অন্যের হাতে তুলে দেবার আগে একবার লাইলিকে দেখার বড় সাধ হলো। আর যেমনি লাইলির সেই অপূর্ব মুখখানার দিকে তাকালো, তেমনি সে ভুলে গেল মজনুকে দেয়া প্রতিজ্ঞা– লাইলি-মজনুর বিরহ বা মিলনের কথা! মন্ত্রী সাথে মিলে তখন রাজপুত্র ষড়যন্ত্র করলো, যে করেই হোক মজনুকে পথ থেকে সরাতে হবে!
মন্ত্রী বুদ্ধি দিল, বিয়ের দিন শরবতের পাত্রে করে মজনুকে দেয়া হবে হলাহল বিষ! সেই বিষে মজনু যখন দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবে, তখন লাইলিকে পেতে আর কোনো বাধা থাকবে না।
বিয়ের দিন চারদিকে লাল-নীল বাতিতে সাজলো চারিদিক। মজনুকে পরানো হলো বরের সাজ, তাকে বসানো হলো মণিমুক্তাখচিত সিংহাসনে। তার পাশে রাজপুত্র। চারদিকে দাসদের আনাগোনা। এরই মাঝে শরবত পরিবেশন করা হলো, রাজপুত্র ও মজনু দুজনেই শরবত পান করলেন। কিন্তু ভাগ্যগুণে ষড়যন্ত্রের পাশা উলটে গেল। মজনু নয়, বিষযুক্ত শরবত খেল রাজপুত্র, নিমেষেই ঢলে পড়লো মাটিতে। নিজের আনা বিষে নিজেই মারা গেল রাজপুত্র। ওদিকে লাইলি-মজনু আবারো আলাদা। বন্ধুরূপে এমন হিংসা দেখে মজনুর মন আরো একবার ভেঙে গেল। এক প্রেমে জীবনের সব আপনজন, সুখ-শান্তি হারিয়ে মজনু এবার আর যেন সেই প্রেমের মিলন চাইলো না। মজনু বিলীন হয়ে গেল ফুলের মাঝে, গাছের তলায়– বাতাসে উড়ে যাওয়া পরাগরেনুর মাঝেও তার চোখে ভাসলো লাইলি, শুধু লাইলি। আর মানবী লাইলি? তার চেয়েও অনেক উঁচুতে উঠে গেছে মজনুর প্রেম, অনুভূতির ঢেউ।
“লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া মজনু গো, আঁখি খোলো”
মজনুর কাছে লাইলি এসেছিল বটে। কিন্তু তার আসতে বড় বেশি দেরি হয়ে গেলো। লাইলিকে ফিরিয়ে দেয়ার সময় সে বলে,
“এ পৃথিবীতে আমাদের এক হওয়া সম্ভব নয়। আকাশের গায়ে চেয়ে দেখো, আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে পুষ্পশোভিত অমরাবতী– তার দুই পাশে দুই সিংহাসন, প্রিয়, সে তো আমাদেরই জন্য!”
হয়তো তাই হয়েছে। কেননা এর কিছুদিন পরই বাবার বাড়িতে লাইলি ধুঁকে ধুঁকে মারা যান, আর বনের পশুপাখির মাঝখানে মৃত্যু হয় মজনুর। রয়ে যায় শুধু লাইলি-মজনুর অমর গল্পকথা।