Manikpirer Jahuranama

Manikpirer Jahuranama

Bengali Title

মানিক পীরের জহুরানামা

Category
Puthi Literature
Source

আল্লাহর অভিপ্রায় ছিল, দুনিয়াতে তার বাণী প্রচার করার জন্য মানিক নামে এক অবতার প্রেরণ করবেন। কলিযুগে যে পৃথিবীতে আসবে এবং মানুষকে হজ, গাজী, মুহাম্মদ, রহিম, করিম, রাসুল, পয়গম্বর, ইজ্জত এবং মাদার সম্পর্কে জানাবে। বদর বললেন, তিনি এই দায়িত্ব নিতে রাজি। আল্লাহ তখন তার প্রিয় বান্দা বদরের গুণগান করলেন এবং সেইসাথে সতর্ক করে দিলেন, বদর যেন কোনো নারীর বশীভূত না হন। তাহলেই তিনি পথ হারাবেন। আল্লাহর সব দিকনির্দেশনা জেনে নিয়ে বদর তার কাজে নামার প্রস্তুতি নিলেন। তবে যাবার আগে তিনি আবেদন করলেন, ‘খোদা, আমি কি ফকির মুর্শিদের বেশে পৃথিবীতে যেতে পারি?’ তখন আল্লাহ বদরের জন্য নিয়ে এলেন আলখাল্লা, পাজামা, কোমরবন্ধ, একটি লাঠি।

দুলদুল নামে একটি ঘোড়া হলো বদরের সঙ্গী। আর তার হাতে দেয়া হয়েছিল এক ছড়া বাশ। বদর ছিলেন সুদর্শন। তার গলায় ছিল হার, মাথায় টুপি, এবং পরনে ঝলমলে মণিমুক্তা। আল্লাহর প্রতি তার বিশ্বাস জানিয়ে বদর তার যাত্রা শুরু করলেন।

আল্লাহ-নাম জপতে জপতে বদর দিল্লির পথে রওনা হলেন। প্রথমে নামলেন লাহোর শহরে। ফকির বেশে তিনি দান গ্রহণ করতেন। 'দম দম মাদার’ – বাক্য পাঠ করে তিনি বহু দূর পথ পাড়ি দিয়ে ফেলতেন। তাকে দেখে আশেপাশের নারী-পুরুষ সোনার থালায় চারটে কড়ি এগিয়ে দিয়ে বলতো, 'হে মুনি, আমাদের দান গ্রহণ করুন’। কিন্তু বদর নিতেন না। বলতেন, ‘আমি তোমাদের মুর্শিদ না হলে এ দান নিতে পারবো না।” তারা ভেবে বললো, ‘জন্মের পর হতে আমরা কখনো প্রকৃত মুর্শিদ পাইনি।” বদর বললেন, তাহলে তোমরা তিনবার ‘এদ আল্লা! এদ আল্লা’ বলো, তবেই তোমাদের দান আমি গ্রহণ করবো। নাহলে এই দান নেওয়া আল্লাহর দরবারে পাপ হবে।’

তখন সবাই তাকে মুর্শিদ হিসেবে মেনে নিলো। লাহোরবাসী দলে দলে ছুটে আসতে লাগলো, দানের থালা স্তুপ হয়ে গেলো। সবাই বললো “ আপনাকে আমরা আজীবনের জন্য হৃদয়ে স্থান দিলাম। মেয়েরা কাঁদতে লাগলো। সবাই বদরের সফরসঙ্গী হতে চাইলো। কিন্তু বদর তাদের শান্ত করলেন এবং তাদের রেখে দিল্লির পথে রওনা দিলেন।

বদর শান্তিপুর ছেড়ে শাহবাজারে আসলেন। সেখানে গোলাম আলি সাহেবকে বললেন তিনি চট্টগ্রামে যাবেন আল্লাহর বাণী প্রচার করতে। নদনদী পেরিয়ে কিছুদিন পরেই বদর সপ্তগ্রামে পৌছলেন, যেখানে গঙ্গাদেবী প্রবাহিত হচ্ছেন। গঙ্গার তীরে ত্রিবেণীর ঘাটে মুনি ঋষিরা তপস্যা করছিলেন। তারা এতো দীর্ঘ সময় একইভাবে বসে তপস্যা করছিলেন যে চারপাশে ঘাস গজিয়ে তাদের দেহ ঢেকে গেছে। কিন্তু তাদের নয়ন-মন অস্থির, ফলে গঙ্গার দর্শন মেলেনি।

বদরকে দেখে তারা ‘হতভাগা নেড়ে’ বলে উপহাস করলো। বদর তাদের অহমিকাপূর্ণ কথা শুনে বললেন, তিনি নিজেই গঙ্গাকে আহ্বান করে আনতে পারেন।

একথা শুনে মুনিরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। ‘তুই কোথাকার কোন নেড়ে ফকির, আমরা ১২ বছর তপস্যা করতে করতে ঘাস গজিয়ে ফেললাম, তাও ব্রহ্মার জননী গঙ্গা দেখা দিলেন না– আর আজ তুই বলামাত্র এসে হাজির হবেন? নিজেকে কী ভাবিস?’

এবার বদরও রেগে গেলেন। ‘দেখো তবে আমার কেরামতি’। বাঘের চামড়ায় বসে তিনি গভীর মনোযগে তপস্যা শুরু করলেন। গঙ্গার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘গঙ্গা, দেখা দাও, তোমার বড় ভাই ডাকছি”।

একথা বলার সাথে সাথে গঙ্গাদেবী আবির্ভূত হতে শুরু করলেন। তাকে দেখেই ঋষিদের দুই হাত চারটা হয়ে গেলো, তারা তক্ষুনি ব্রহ্মলোকে চলে গেলেন। বদর বললেন, তিনি গঙ্গার পাদপদ্ম দেখতে চান। কিন্তু দেবী মুসলমান তথা যবনদের দেখা দেন না। পরে বদরের বারংবার ডাকে তিনি শর্ত দিলেন, বদর তার সাত ঢেউয়ের বেগ সহ্য করতে পারলে তবেই তিনি দর্শন দেবেন। বদর রাজি।

কিন্তু ঢেউ যখন ফুলে উঠলো, বদর দেখলেন অবস্থা বেগতিক। তিনি একমনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলেন, ‘আল্লাহ এবার বাঁচিয়ে দাও।’ আল্লাহ বাতাস তথা পবনকে আদেশ করলেন সে যেন তখুনি গিয়ে গঙ্গাকে বদরের থলেতে ঢোকানোর ব্যবস্থা করে। পবনের কথা শুনে বদর তার থলের মুখ খুলে ধরে রাখলেন। এদিকে গঙ্গার বিরাটাকায় ঢেউগুলো ছুটে আসছে। বদর আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে ঐ ঢেউয়ের মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিন্তু ঢেউ আছড়ে পড়তে পড়তে গঙ্গাদেবী বদরের থলেতে ঢুকে গেলেন। বদর তখনই থলের মুখ বেঁধে ফেললেন! আর এভাবেই ভাগীরথী নদী বশে এলো।

এবার বদর নদীতটে পাট বুনলেন। আল্লাহর কুদরতে অতিদ্রুত পাটের অঙ্কুর বের হলো; একদিনেই তাতে পাতা গজালো আর সাতদিনের মধ্যে পাটের কাণ্ড-শিকড় বেড়ে উঠে ফুল-ফলও চলে আসলো। বদর আনন্দের সাথে পাটশাক রান্না করে আল্লাহকে নিবেদন করলেন।

এদিকে গঙ্গা ক্লান্ত হয়ে হার মানলো, ‘মানছি তুমি আমার পূর্বজন্মের বড় ভাই। এবার আমাকে মুক্তি দাও।’ বদর বললেন, ‘ছাড়তে পারি, কিন্তু কথা দাও, তুমি শান্ত হয়েছো।’ গঙ্গা মানলো। এবার থলের মুখ খুলতেই গঙ্গা তুমুল বেগে আছড়ে পড়ে ত্রিবেণী প্লাবিত করে দিল। সেই থেকেই নদীটা ওখানে কুঁজোর মতো বাঁকা। বদর এবার গঙ্গাকে অনুরোধ করলেন সেতুবন্ধ থেকে তার জন্য ত্রিবেণীতে পাথর এনে দিতে। তখন গঙ্গাদেবীর অলৌকিক ক্ষমতাবলে সমুদ্রের পাথর পানির ওপর ভেসে উঠলো। দেবী সেগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে এলেন বদরের কাছে।

পাথর দেখে খুশি হয়ে বদর ডাকলেন মহাজাগতিক স্থপতি বিশ্বকর্মাকে। তাকে পান এবং ফুল নিবেদন করে বললেন সাত দিন সাত রাতের মধ্যে একটা মসজিদ তৈরি করে দিতে। বিশ্ব বললেন, ‘আমি রাজি। কিন্তু তোমাকে পুরোটা সময় রাতের অন্ধকার করে রাখতে হবে। যখন আঁধার কেটে ভোর হয়ে যাবে, তোমার মসজিদের কাজ বাকি থাকলেও আমি চলে যাবো।’ বদর সেদিনই রাতকে ডেকে বললেন পরের সাত দিবসকে রাত করে রাখতে। তা-ই হলো। বিশ্বকর্মাও কাজ শুরু করলেন।

দুদিন ঠিকঠাক গেল। কিন্তু আল্লাহ শঙ্কায় পড়ে গেলেন যে বিশ্বকর্মার মসজিদ যদি মক্কা-মদিনা কিংবা বেহেশতের চেয়েও সুন্দর হয়ে যায়! তিনি আলীকে ডেকে বললেন, একটা সাদা কাকের রূপ নিয়ে দ্রুত উড়াল দিতে। আলী আদেশ পালন করলেন। দেখা গেলো, চাঁপাগাছের ডালে বসে একটা সাদা কাক কা কা করে ডাকছে। সেই ডাক শুনে ভোর হয়ে গেলো, ভোরের আলোয় চাঁদ মিলিয়ে গেল আর বিশ্বকর্মাও তার কুড়াল ফেলে মসজিদ অর্ধেক বাকি রেখেই উধাও হয়ে গেলেন।

এ অবস্থায় বদর দফরগাঁ গাজীকে ডাকলেন। ‘তুমি এখন থেকে ত্রিবেণীতে থাকবে, লোকে তোমাকে ফুল এবং শিন্নি দেবে। এখানে একটা বেঙ্গমা-বেঙ্গমির ডিম আঁকা নিশান বসিয়ে দিয়ে যাচ্ছি।’ তারপর বদর কাঠের খড়ম পায়ে গঙ্গা পেরিয়ে চট্টগ্রামের পথে রওনা দিলেন। পথিমধ্যে তিনি ঠিক করলেন দিল্লির বাদশাহের কাছে যাবেন।

বাদশাহের দরবারে বদরকে মনে হচ্ছিল যেন নিকষ কালো রাতে উজ্জ্বল চাঁদ। কিন্তু তার ফকিরের পোশাক দেখে বাদশাহ জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে তোমার কী চাই?’ বদর বললেন, ‘বাদশা, আমার একটা আরজি আছে। আপনি আগে বলুন পূরণ করবেন, তাহলে আমি বলবো।’ বাদশাহ শুনে রেগে আগুন। উজির খেপে বললো, ‘কে তুমি? বাদশাহকে এভাবে বলার স্পর্ধা কীভাবে হলো?’

বদর বললেন, ‘বাদশাহ, আপনাকে আমি ভয় করি না। জেনে রাখবেন, আপনার হবু জামাতা এখন আপনার সামনে দাঁড়িয়ে।’

উজির বললো, ‘বাদশাহ, একে বন্দি করে ৩ দিন কয়েদখানায় ফেলে রাখুন।’ তখুনি বাদশাহের হুকুমে সেপাইরা এসে বদরকে মারপিট শুরু করলো। সাথে সাথে তিনি দরবারের সবার চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সবাই তাজ্জব। ওদিকে তিনি গিয়ে নামলেন বনে। সেখানে বসে বসে ঠিক করলেন, বাঘদের দিয়ে তিনি বাদশাহের মেয়েকে ধরে আনবেন।

এবার বদর তার বাঘদের ডাকলেন।

বদরের ডাকে অগুনতি বাঘ-বাঘিনী ছুটে এলো। সবার আগে বাঘ-দলপতি হুম (Hum) বদরকে রাজকীয় সালাম দিল। গর্জন করতে করতে এলো কেদ, মেদ, গোবাগা, সোবাগা, জাতিয়া, মাতিয়া, কালা, তরংঙ্গিনী, অবলাক, সমলাক, নাকেশ্বরী, সোনা, ধনা, উদ, বুদ সহ সর্বমোট ১২ লক্ষ বাঘ। এদের একেকজনের একেক ক্ষমতা। কোনো বাঘের হুংকারে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল স্তব্ধ হয়ে যায়। কেউ আঠারো দিনের পথ এক রাতে অতিক্রম করতে পারে। কেউ বাদাবনে ঘোলা পানিতে ডুবে থাকে এবং সুযোগমতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তীরবর্তী মানুষের ওপর। কোনো বাঘ আবার মানুষের গন্ধ পেলে ছুটে পালায়। অন্য বাঘেরা বনবাসী মানুষকে তটস্থ করে রাখে।

বদর খুশিমনে বাঘেদের সালাম নিলেন। হুকুম করলেন বাদশার প্রাসাদ থেকে তার মেয়েকে তুলে আনতে। আদেশ পাওয়ামাত্র চারটি বাঘ রওনা দিলো। রাত তখন কালির মতো কালো। প্রাসাদের কাছে গিয়ে বাঘগুলো নিঃশব্দে দেয়াল ডিঙ্গিয়ে প্রাসাদের বাগানে নেমে পড়লো। রাজকুমারী দুদবিবি নিজ কক্ষে শুয়ে ছিল। চতুর্দিকে প্রদীপের আলোয় আলোকিত। খাটের চতুর্দিকে সূক্ষ্ণ মশারির জাল আবৃত করে আছে। দুদবিবি নিষ্পাপ ফুলের মতো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। চার বাঘ বিছানার চার পায়া তুলে নিলো। তারা একসাথে এমনভাবে লাফিয়ে দেয়াল পেরিয়ে গেলো যে ঘুমন্ত রাজকন্যা টেরও পেলো না। বাঘেরা বিছানাকে যেন বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে এসে বনের মধ্যে বদরের সামনে রাখলো। বদর যখন মশারি তুললেন, মনে হলো যেন দু’টি চাঁদ একত্র হয়েছে। রাজকন্যার অতুলনীয় রূপে বদর বিমোহিত হয়ে গেলেন। তিনি মৃদুস্বরে ডাকলেন, ‘ওঠো, ওঠো।’

দুদবিবির যখন ঘুম ভাঙলো, তিনি অবাক হয়ে গেলেন। ‘তুমি কে? আমাকে এই বনের মধ্যে এনেছো কেন?’ বদর তাকে সব খুলে বললেন, ‘মন দিয়ে শোনো। বাদশা তার দরবারে আমাকে অপমান করেছিলেন। তাই আমি বাঘদের দিয়ে তোমাকে তুলে এনেছি। এখন তুমি আমাকে বিয়ে করো। তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’