ভারতবর্ষে হুগলির চন্দননগরে জয়ধর সদাগর জন্মগ্রহণ করেন। তার ছিলো তিন পুত্র মদন, কামদেব আর সুন্দর। জয়ধর সদাগর মারা যাবার সময় বড় দুই পুত্র মদন ও কামদেবকে ডেকে ছোট পুত্র সুন্দরের দায়িত্ব তাদের কাছে সঁপে দিয়ে যায়। জয়ধর মারা যাবার পর তিনভাই মিলে তার সৎকার করে। কিছুদিন কেটে যায়। মদন ও কামদেব বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে দূর দেশে যায়। যাবার আগে তাদের স্ত্রী সুমতি ও কুমতির কাছে ছোটভাই সুন্দরকে রেখে যায়। সুন্দর তখন পাঠশালায় যায় পড়াশোনা করতে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মদন ও কামদেব বাণিজ্যে যাবার জন্য নদীতে নৌকা ভাসায়।
“ধুপ-ধুনা জ্বলে কত আর বাজে সিঙ্গা ইষ্ট দেবতা পূজা করি ভাসাইল ডিঙ্গা বাহ বাহ বলিয়া বসিল সওদাগর হুকুম পাইয়া ডিঙ্গা তুলিল লঙ্গর।”
ছয়মাস নৌকা ভাসে এভাবেই। এর পর এক রাজার রাজ্যে গিয়ে তারা নৌকা ভিড়ালো। নৌকা থেকে নেমে রাজদরবারে গিয়ে তারা রাজার সঙ্গে জিনিসপত্র কেনাবেচা করে। কেটে যায় বেশ কিছুদিন।
এদিকে যে কথা কেউ জানে না, তা হচ্ছে– সওদাগরের বউ সুমতি ও কুমতি মানুষ নয়, ছিল ডাকিনী। তাইতো তারা দিনের বেলা ঘর থেকে বের হতো না। রাতের আঁধার ঘন হয়ে আসলেই দুজনে মন্ত্র পড়ে গাছে চেপে রওনা দিতো অন্য দেশ ঘুরতে। এক রাতে হঠাৎ সুন্দরের ঘুম ভেঙে যায়, উঠে দেখে, বাড়িতে বৌদিরা নেই। তার বড় দুশ্চিন্তা হয়। এই নিশিরাতে এমন যুবতী দুই নারী কোথায় গেলো? তবে ভোর হতে না হতেই ফিরে আসে তারা দুজন। সুন্দরকে ভুলিয়ে ভালিয়ে আবার ঘুম পাড়িয়ে দেয়। কিন্তু সুন্দর ছিল বুদ্ধিমান ছেলে। তারা দুজন যে ডাকিনী, একথা সে বুঝে ফেলে। সুমতি কুমতি তখন নিজেদের গুপ্তকথা ঢাকবার জন্য সুন্দরকে মেরে ফেলার ফন্দি আঁটে। একদিন ভালোমন্দ রান্না করে সুন্দরকে খাওয়ানোর পর তারা সুন্দরের বুকে রক্তবাণ মারে। ঝলকে ঝলকে রক্ত ওঠে সুন্দরের মুখে। সুন্দর মারা গেলে দুই বোন তাকে জঙ্গলে ফেলে আসে।
সত্যপীরের অসীম দয়ায় পীর উপস্থিত হন জঙ্গলে সুন্দরের কাছে। অলৌকিক ক্ষমতাবলে তিনি জাগিয়ে তুলেন তাকে। জীবিত হয়ে সুন্দর আবারো ঘরে ফিরে যায়। সুন্দরকে জীবিত দেখে সুমতি কুমতি অবাক হয়ে যায়, “এ বেঁচে ফিরলো কীভাবে!” তখন তারা সুন্দরকে কেটে দুইভাগ করার ফন্দি করে। রাতে সুন্দর ঘুমায়। তারা দুইজনে মিলে সুন্দরের দেহ থেকে মাথা কেটে আলাদা করে জঙ্গলে গিয়ে রেখে আসে।
“কান্দিয়া সুন্দর সত্যপীরে বলে সুমতি কুমতি ছুরি দিল তার গলে, দুই হাতে কাটে মাথা কামিখ্যার গিয়ানী কাটিয়ে সুন্দরে ফের করে দুই খানি।।”
কিন্তু সত্যপীরের কৃপায় সুন্দর আবারো জীবিত হয়।
সুন্দর আবারো ঘরে ফিরে গেলে দুই ডাকিনী তাকে দেখে খুবই অবাক হয়ে যায়। এত কিছু করার পরেও কেন মারা যাচ্ছে না সুন্দরকে? রাতের বেলা সুন্দর ঘুমায়। এবার তারা সুন্দরকে কেটে সাত টুকরা করে জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে মাটিচাপা দিয়ে আসে। একইভাবে সুন্দর সত্যপীরকে স্মরণ করলে পীর এসে তাকে আবারো জীবিত করেন। এবার সুন্দর আর বাড়িতে যেতে চায় না। কী হবে বাড়ি ফিরে– যে বাড়িতে অপেক্ষা করে আছে বারংবার মৃত্যু?
সে বরং পীরের সঙ্গী হয়ে তার সাথেই থাকতে চায়। পীর তখন সুন্দরকে বলেন, কাউর দেশের গিরিধর রাজার বিমলা নামে এক সুন্দরী কন্যা আছে, যার স্বয়ংবর হবে আজকেই। সুন্দরের সাথেই বিয়ে দেবেন বিমলার– এই বলে পীর সুন্দরকে নিয়ে গিয়ে সেই জাদুর গাছের মধ্যে লুকিয়ে রাখেন।
এদিকে সুমতি-কুমতিও জানতে পারে বিমলার স্বয়ংবরের কথা। বিয়ে দেখার জন্য তারা রাতের বেলা সেই গাছে চড়ে যায় কাউর দেশে।
“আসমান উপরে যখন নিশি ভাগ রাতি হেনকালে গাছে চেপে চলিল যুবতি, সুমতি কুমতি হৈল গাছেতে ছত্তার গিয়ান পড়িয়া দোহে ছাড়িয়া হুঙ্কার, গাছেতে চড়িয়া মন্ত্র ফুকারিয়া আগে চলিল কাউরে গাছ পবনের বেগে।।”
সত্যপীর একজন সন্ন্যাসীর বেশ ধরে সুন্দরকে নিয়ে যান রাজদরবারে। পীরের মায়ায় সুন্দরের রূপ দ্বিগুণ হয়ে যায়; যেন চাঁদ এসে ভর করেছে তার চেহারায়! পীরের মায়ায় ভগবতী দেবী বিমলার সামনে উদয় হন। দেবী বলেন- “এত চিন্তা কেন করছো? ওই যে দেখো, তোমার স্বামী সন্ন্যাসীর পাশে বসে আছে। আমি আগে থেকেই তোমার ভাগ্য লিখে রেখেছি। তুমি সুন্দরের গলায় বরমালা দাও।” দেবীর কথামতো বিমলা সুন্দরের গলায় বরমালা দেয়। রাজা গিরিধর তখন অনেক সামগ্রী দিয়ে ধুমধাম করে সুন্দর ও বিমলার বিয়ে দেন।
বিয়েশেষে সুন্দর স্ত্রী বিমলার সঙ্গে তার ঘরে যায়। সারাদিনের ক্লান্তিতে তারা ঘুমিয়ে পড়ে। এদিকে সুমতি-কুমতি সেই জাদুর গাছে চড়ে বাড়ি ফিরে যাবে। তখন সত্যপীর সুন্দরকে স্বপ্নে দেখায়, এখন জাদুর গাছে না গেলে সুন্দর আর বাড়িতে ফিরতে পারবে না। উপায় না পেয়ে সুন্দর ঘুমন্ত বিমলার শাড়ির আঁচলে কাজলের কালি দিয়ে তার জন্মপরিচয় এবং দেশের নাম লিখে রেখে আসে। সত্যপীর তখন পুনরায় সুন্দরকে মায়াবলে সেই গাছের কোটরে লুকিয়ে রাখে।
সুমতি-কুমতি দেশে ফিরে জাদুর গাছটা নিজ জায়গায় রেখে ঘরে আসে। তারা আসার একটু পরে সুন্দরও ফিরে আসে ঘরে। সুন্দরকে দেখে তারা দুজন অবাক হয়ে যায়। কেটে সাত টুকরা করার পরেও কেন সুন্দর মারা যাচ্ছে না, এটা তারা ভেবে পায় না। অবশেষে তারা ফন্দি করে সুন্দরকে ওষধি গাছ খাইয়ে পাখি বানিয়ে দিবে। যেই বলা সেই কাজ। তারা দুজনে ওষধি গাছ এনে সুন্দরকে পাখি বানিয়ে দেয়, আর সুন্দরও পাখি হয়ে উড়ে যায় পীরের কাছে।
“এত বলি ঔষধের আনিল শিকড় বান্ধিয়া দিলেক জড়ী মস্তক উপর, এমন শিকড় বেন্ধে দিল দুইজনে পক্ষী করে উড়াইল সাধুর নন্দনে, সোয়া পক্ষী হৈয়া উড়ে চলিল সুন্দর সত্যপীর লিয়া তারে চলিল সফর।”
এদিকে বিমলা ঘুম থেকে উঠে দেখে, পাশে স্বামী নেই। স্বামীকে না দেখে বিমলা অঝোর ধারায় কান্না শুরু করে। মেয়ের কান্না শুনে ছুটে আছে দাসীরা, ছুটে আসেন রানী। রানী বিমলার থেকে সকল কথা শুনে নিজেও কান্না শুরু করেন। হঠাৎ রানী দেখেন, বিমলার আঁচলে সুন্দর করে জামাতা সুন্দরের সমস্ত বিবরণ লেখা আছে। এই দেখে তারা শান্ত হয়ে রাজার কাছে যান। রাজা সমস্ত ঘটনা শোনেন, কিন্তু কোনো উপায় খুঁজে পান না। তখন বিমলা বলে- “আমি আমার স্বামীর দেশে যাবো, আমাকে সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করো।” একথা শুনে রাজা বিভিন্ন সামান-সামগ্রী সহ বিমলাকে নৌকায় করে চন্দন নগরে পাঠিয়ে দেন।
চন্দন নগরে পৌঁছে বিমলার সুমতি-কুমতির সঙ্গে দেখা হয়। তাদের কাছ থেকে সে শোনে, সুন্দর বাড়িতে নেই, কোথায় গেছে– তারা কেউ জানে না। এসব শুনে দুঃখভারাক্রান্ত মনে কান্না শুরু করে বিমলা। তখন সত্যপীর একটি সাদা মাছির রূপ ধরে বিমলার কাঁধে বসে বিমলাকে বলে- “কান্না করো না তুমি। তোমার স্বামী সুন্দর এখানেই থাকে, আর এখানেই ফিরে আসবে।”
“শ্বেতমাছি রূপে আসি, কন্যার কান্ধেতে বসি, কহিলেন সত্য নারায়ণে, রাজার নন্দিনী শুন, অকারণে কাঁদ কেন, পাবে পতি থাকে এইখানে।”
একথা শুনে বিমলা শান্ত হয়। সে তখন সুমতি-কুমতির সঙ্গে সুন্দরের বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।
এদিকে সুন্দর সোনার পাখি হয়ে যে বনে ছিলো, সেই বনে শিকার করতে এলো কিছু পাখি শিকারী। সত্যপীর মায়াবলে বনের সমস্ত পাখিকে লুকিয়ে রাখলো গাছের পাতার মধ্যে। যখন শিকার করার মতো পাখি না পেয়ে শিকারীরা ফিরে যাচ্ছিল, এমন সময় তাদের সামনে আসলেন সত্যপীর। তিনি বললেন, “ওই যে দেখো, একটা সোনার পাখি। তোমরা ওই পাখিটা নিয়ে যাও, বাজারে অনেক টাকায় বিক্রি করতে পারবে।” শিকারীরা তখন পীরকে অশেষ ধন্যবাদ ও সালাম জানিয়ে সোনার পাখিরূপ সুন্দরকে খাঁচায় বন্দি করে বাজারে রওনা দেয়।
বাজারে পৌঁছে শিকারীরা সোনার পাখির দাম রাখে এক হাজার টাকা। এদিকে মদন ও কামদেব সেই বাজার ধরেই ফিরছিলো বাড়ির দিকে। সোনার পাখি দেখেই তাদের মনে পড়ে যায় ছোটভাই সুন্দরের কথা। সুন্দর ঠিক এমনি একটা সোনার পাখি আনতে বলছিলো তার জন্য। মদন ও কামদেব তখন হাজার টাকার বিনিময়ে পাখিটা কিনে বাড়ির পথে নৌকা ভাসায়।
“হাজার টাকার তোড়া যেই জন দিবে এই শুয়াপক্ষী আমার কিনিয়া লইবে, মদন কামদেব তবে এতেক শুনিয়া হাজার টাকার তোড়া দিলেক আনিয়া, সোনার পিঞ্জিরা বানাইল সওদাগর সোয়া পক্ষী লিয়া রাখে তাহার ভিতর।”
বাড়িতে ফিরে তারা সুমতি কুমতির কাছে ভাই সুন্দরের খোঁজ করে। সুমতি কুমতি তখন বলে- “তোমরা যাবার পর থেকেই সুন্দর দুশ্চরিত্র হয়ে যায়। সে দিনের বেলা ঘুমায় আর রাতের বেলা মেয়েদের জানালায় উঁকিঝুঁকি দেয়। এমন করতে করতে হঠাৎ একদিন সে এক রাক্ষসীকে বিয়ে করে বাড়িতে আনে। পরে সেই রাক্ষসীর বিষে সুন্দর মারা যায়।”
মদন কামদেব এই কথা শুনে মাটিতে পড়ে কান্নাকাটি শুরু করে।
সুমতি কুমতি তখন বলে- “কান্নাকাটি করে কি হবে। সুন্দরের ঘরে ওর স্ত্রী আছে, এই সোনার পাখিটা তাকে দিয়ে আসো। সে এর সেবাযত্ন করে লালন-পালন করুক। এই পাখিকে দেখেই নাহয় সুন্দরের কথা মনে করবে তোমরা।”
মদন আর কামদেব তখন পাখিটা দিয়ে আসে বিমলা সুন্দরীকে। বলে দেয়, যেন পাখিটার ঠিকভাবে যত্ন করে। এদিকে স্বামীহীনা বিমলার বুক ফেটে যায়। হায় হায় বলে সে কপাল চাপড়াতে থাকে। বিমলার কষ্ট দেখে সত্যপীর বিমলাকে স্বপ্নে দেখায়, “ওই সোনার পাখিটাই হলো সুন্দর। পাখির মাথায় একটা জাদুর শিকড় বাঁধা আছে, যা খুলে দিলেই সুন্দর মানুষ রূপ ফিরে পাবে।” স্বপ্ন দেখে হকচকিয়ে উঠে বিমলা। খাঁচা নিয়ে এসে পাখির মাথা থেকে খুলে ফেলে শিকড়টি। তখন মানুষরূপ ফিরে পায় সুন্দর।
“মস্তকে ঔষধ বান্ধা আছে একখানি তখনি খুলিয়া দিলো রাজার নন্দিনী, ঔষধের গুণে সাধু পক্ষী হইয়াছিল ঔষধ খুলিনে সাধু মানুষ হইলো।”
সুন্দরকে দেখে বিমলা পায়ে পড়ে কান্নাকাটি শুরু করে। তখন সুন্দর সব কথা বিমলাকে খুলে বলে। সুন্দরের সব কথা শুনে বিমলা আবার সুন্দরের মাথায় সেই শিকড় বেঁধে পুনরায় তাকে পাখি করে রাখে। রাতের বেলা বিমলা মদন ও কামদেবকে ভাত বেড়ে খেতে ডাকে। দুই ভাই খেতে আসলে বিমলা সুন্দরের খোঁজ করে তাদের কাছে। দুই ভাই তখন আবার হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করে। বিমলা তখন বলে- “আমি জানি, সুন্দর কোথায় আছে। দাঁড়ান নিয়ে আসি তাকে।” এই বলে বিমলা পাখির খাঁচাটা এনে পাখির মাথা থেকে জাদুর শিকড়টা খুলে ফেলে। সুন্দর তখন মানুষরূপ ফিরে পায়। সুন্দরকে ফিরে পেয়ে মদন-কামদেব তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে। সুন্দরের কাছে সকল বৃত্তান্ত জানতে চাইলে সুন্দর সুমতি-কুমতির সকল গোপন কথা বলে দেয় ভাইদের।
সুন্দরের মুখে সকল কথা শুনে মদন ও কামদেব রাগে-ক্রোধে জ্বলতে থাকে। কাজের লোক ডেকে বলে, বাড়ির মধ্যে বড় একটা গর্ত খুঁড়তে। গর্ত খোঁড়া হয়ে গেলে দুই ভাই সুমতি-কুমতিকে গিয়ে বলে- “বাড়িতে আজ ডাকাত আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তোমরা তোমাদের জিনিসপত্র নিয়ে ওই গর্তে লুকিয়ে থাকো।” একথা শুনে দুইবোন তাড়াতাড়ি করে তাদের সোনাদানা নিয়ে গর্তে প্রবেশ করে। এদিকে মদন আর কামদেবের ইশারায় কাজের লোকেরা গর্তে কাঠ ফেলে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। সেই আগুনে পুড়ে চিৎকার করতে করতে মারা যায় সুমতি-কুমতি।
“দুইজন নামিল যদি খন্দক ভিতরে কাঠপালা সাজাইয়া রাখে থরে থরে, দুই সওদাগর তারা নজরে দেখিয়া কাঠ পালা পাট সাটি দিল জ্বালাইয়া।”
তারপর মদন ও কামদেব মিলে আড়ম্বর ভরে সত্যপীরের পূজা করে এবং শিরনী রান্না করে দেশের সকল গরীব লোকেদের খাওয়ায়। তারপর থেকে তারা সত্যপীরের আশীর্বাদে তারা বেশ সুখে-শান্তিতেই দিন কাটাতে থাকে। সত্যপীরকে অনেকে সত্যনারায়ণ বলেও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।