সে বহুকাল আগের কথা। এক দেশে থাকতো এক দুষ্ট রাজা আর তার মহাদুষ্ট রানি। দুজনে মিলে প্রজাদের উপর যারপরনাই অত্যাচার করতো। পান থেকে চুন খসলেই যেত সিপাহিদের গর্দান। দাসী-বাঁদিরা সারাক্ষণ ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকতো, কখন কী ভুলে প্রাণটাই না হারাতে হয়! চাপে এক চামচ চিনি কম পড়লো কি রানি সাজগোজের সময় কোনো দাসী একটু কেমন করে তাকালো তার দিকে– ব্যস! রক্ষে নেই কারুরই, এই দুষ্ট রাজার দেশে। সে রাজ্যের ধানক্ষেতে সোনালী ধানের ঢেউ– বনে-জঙ্গলে বয়ে যেত স্বচ্ছ ঝরনার ধারা। রাজার জন্য মায়াদয়া না থাকলেও রাজ্যটাকে সকলেই খুব ভালোবাসতো।
আসলে রাজার মনেও আরাম ছিল না। আর সেই জন্যই অন্য সবার সঙ্গে এত খারাপ ব্যবহার, এত অশান্তি। রাজার প্রতিটি বছর শুরু হতো আনন্দ দিয়ে, কিন্তু যে-ই বছরের মাসগুলো কেটে যেত, রাজা যেন একেবারে বিষাদে ডুবে যেতেন। আর রাজা সবার সাথে যাচ্ছেতাই করে চলতেন, সেই বিষাদ ছেয়ে যেত রাজ্যের সকলের মনেও।
সেবার শরৎকাল। বছর ঘুরে রাজারও ভালো থাকার দিন শেষ। এমনই একদিন হলো কি, রাজার বড় বেশি অসুখ করলো। মাথা যেন ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে, রাজকার্যে মন দেয়া তো দূরের কথা– ভালো করে দাঁড়াতেও পারছেন না। সারাক্ষণ শুধু পাগলের মতো তারস্বরে চিৎকার করে চলেছেন। রাজার অসুখ, বদ্যি-হাকিমের কোনো অভাব তো আর নেই। রানির তলবে দেশের সব হাকিমই এলো, কিন্তু হায়, কেউই রাজাকে সারিয়ে তুলতে পারল না।
আর রাজার যে বিচ্ছিরি মেজাজ, একে একে সব হাকিমকে শূলে চড়ালেন। এমন করতে করতে একদিন সে রাজ্যে আর কোনো হাকিমই বাকি রইল না। এদিকে সবার মাঝে গুজগুজ, ফুসফুস– “রাজার অসুখ তবে সারবে কীসে?” এমন অহংকারী রাজা, তার অসুখ না সারলেও অবশ্য কারো তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। শুধু রাজা বলেই এত খেয়াল রাখতে হচ্ছে।
কিন্তু বদ্যি-হাকিম সবাই তো শূলে চড়েছে। নতুন বৈদ্য মিলবে কই? আসলে শাস্তির ভয়ে বাকি যে দু চারজন বেঁচে গেছিল, তারাও আর সামনে এগিয়ে আসছে না। রাজার মেজাজে প্রাণ হারাবে– প্রাণ কি এত সস্তা নাকি? শুধু হাকিম নয়, কবিরাজ-জাদুকর, এদের উপরও শমন জারি হলো। এসে রাজার অসুখ সারাতে হবে। কোনো কোনো জাদুকর সত্যি কথাটা বলতে গিয়েও থেমে যায়, পাছে রাজার মেজাজ চড়ে যায়! পরে এক সাহসী ওঝা এসে দাঁড়ালো রাজার দুয়ারে। তবে রাজার কাছে এসে সেও ভয়ে কাঁপতে লাগলো। অনেক কষ্টে কিছু সাহস জড়ো করে সে বললো, “মাফ করবেন রাজামশাই! আমি এমন কোনো অসুখ এ জীবনে দেখিনি। এ অসুখের একটাই কারণ থাকতে পারে। আসলে আগের জন্মে আপনি একটি কুকুর ছিলেন, আর…” এর পরের শব্দগুলো বলার ভাগ্য সে বেচারা ওঝার হয়নি। এর আগেই রাজার তলোয়ারে তার গলাখানা কাটা পড়েছে। এ খবর পাবার পর বাকি যারা ওঝা-কবিরাজ ছিল, তারাও পাততাড়ি গুটিয়ে রাজ্য থেকে পালালো।
রাজার অসুখ দিনে দিনে বাড়লো। একটু স্বস্তি মিললো না। এভাবেই অনেকদিন কেটে গেল। একদিন রাজবাড়ির এক চাকর এসে রানিকে খবর দিল, রাজ্যের শেষ প্রান্তে এক পর্বতের চূড়ায় বাস করেন এক মহা সাধক– সন্ন্যাসী। সেই সন্ন্যাসী ঝড়বৃষ্টি-রোদ, দুর্যোগ যাই হোক না কেন, নিজের আশ্রমখানা ছেড়ে কোথাও যান না। সে সাধকের আছে বহু ওষধি শক্তি, তিনি নিশ্চয় রাজাকে সারিয়ে তুলতে পারবেন। এমন কথা শুনে যেন মেঘের কোলে রোদ হাসলো। রানি আশা ফিরে পেলেন। সেই চাকরকে দিয়ে খবর পাঠালেন সাধকের কাছে। কিন্তু সাধক প্রথমে রাজি হলেন না। তিনি বললেন, “এ রাজা বহু লোকের ক্ষতি করেছে– বহু নির্দোষকে অকারণে শূলে চড়িয়েছে, রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে নিরীহ মানুষজনকে। এর চিকিৎসা করে পাপের ভাগীদার হতে চাই না।” কিন্তু সেই চাকরটি বহুদিন ধরে সন্ন্যাসীর সেবা করে আসছে, সে নিজের কাজের বিনিময়ে এইটুকুনি ভিক্ষা চাইলো– রাজার প্রাণ। অগত্যা সন্ন্যাসী রাজি হলেন। কিন্তু জুড়ে দিলেন এক অদ্ভুত শর্ত।
“আমি আমার আশ্রম ছেড়ে রাজবাড়ি যাব না। রাজাকেই এখানে আসতে হবে। নিরস্ত্র, নিঃসঙ্গ। রাজা নিজের দুই পায়ে হেঁটে আমার এই পর্বতচূড়ায় এলে তবেই আমি তাকে সারিয়ে তোলার কথা ভাবব।”
স্বাভাবিক অবস্থায় রাজা-রানি কেউই এমন কথাকে পাত্তা দিতেন না, বরং শূলে চড়াতেন সন্ন্যাসীকেও। কিন্তু মাথাব্যথায় রাজার অবস্থা এতই বেগতিক যে এমন শর্তও মানতে হলো তাদেরকে। রাজা বহু কষ্টে চড়লেন সেই পর্বতের মাথায়, যেখানে আছে সন্ন্যাসীর আশ্রম। রাগে-দুঃখে-তৃষ্ণায় রাজা যখন একেবারে কাবু, তখন তার সাথে দেখা হলো রহস্যময় সে সন্ন্যাসীর। ধ্যানরত সন্ন্যাসীকে দেখে এক নিমেষে রাজার রাগ জল হয়ে গেল। তার মাথা থেকে বেরিয়ে আসা শান্তিময় আলো দেখে রাজা মুগ্ধ হয়ে গেলেন। সন্ন্যাসী চোখ মেলে রাজার হাতে ধরিয়ে দিলেন এক পাত্র শুদ্ধ জল, যা পান করে রাজা তার জীবনীশক্তি ফিরে পেলেন। এরপর রাজা শান্ত হয়ে বসলেন, সন্ন্যাসী শুরু করলেন তার কথা–
“রাজা, মন দিয়ে শোনো। আমি যতক্ষণ কথা বলব, তুমি চোখ বন্ধ করে থাকবে, শ্বাস-প্রশ্বাস হবে ধীর।
তোমার এই অসুখ কোনো শারীরিক ব্যাধি নয়, এ তোমার গত জন্মের কর্মফল। তোমার পূর্বজন্মের হিসেব-নিকেশ এখনো বাকি রয়ে গেছে, তাই এমন ভোগান্তি।
বহু বহুকাল আগে উত্তরে এক রাজ্য ছিল, সে রাজ্যে তুমি জন্মেছিলে একটি কুকুর হয়ে। রাজ্যের গ্রামে বাস করতো নিরং নামের এক অপূর্ব সুন্দরী বালিকা। তুমি কুকুর হয়েও তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলে– প্রেমে পড়েছিলে তার। যেখানে সে যেত, সেখানেই তুমি যেতে। তার পিছু পিছু ঘুরে ফেরাই ছিল তোমার কাজ। নিরংও তোমাকে স্নেহ করতো। নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাইয়ে-পরিয়ে রাখতো। মনে তার দয়ার কোনো অভাব ছিল না। নিরংয়ের সৌন্দর্যে শুধু তুমি নও, আশপাশের সবাই পাগলপারা। আর তোমাকে দেখে হিংসেয় জ্বলে মরে, ভাবে– আহা! কুকুর হলেও হতো! নিরংয়ের এসবে কিছু আসে-যায় না। সে নিজের মতো ঘরের কাজকর্ম করে, বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়, ঝর্ণার জলে স্নান করে আর নিত্যদিন তোমার সাথে থাকে। এতে করে আশপাশে কানাঘুষা শুরু হলো, নিরং কি তবে ওই কুকুরটিকে বিয়ে করেছে? প্রথমে মজার ছলে শুরু হলেও দিনে দিনে নিরংয়ের জন্য ঘরের বাইরে আসা কঠিন হয়ে গেল। যে-ই তাকে দেখে, আঙুল তুলে বলে– ‘কুকুরের বউ!’ আর তুমি তো সপ্তাহের সাতদিনই সারাক্ষণ তার সাথে রয়েছ। মানুষের কথা শুনে শুনে নিরংয়ের মনের অনুভূতি পালটে যেতে থাকলো। তোমাকে দেখে তার মায়া হয় ঠিকই, সেইসাথে রাগও ওঠে। তোমার কারণেই তো তার মুক্ত জীবনে এমন বন্দিদশা! নিরং একদিন ফন্দি আঁটে, যে করেই হোক– তোমার কাছ থেকে তার মুক্ত হতে হবে। এমন ধুঁকে ধুঁকে বাঁচা, এমনভাবে ‘কুকুরের বউ’ হয়ে থাকা তার পোষাবে না।”
সন্ন্যাসী থামলেন, রাজা চোখ মেলে তাকালেন। সন্ন্যাসী তাকে বললেন,
“আরেক পাত্র জল পান করো। তুমি কি জানতে চাও, নিরং কীভাবে তোমার থেকে মুক্তি পেয়েছিল? কেনই বা প্রতি শরৎ-হেমন্তে তোমার মাথাব্যথা বাড়ে? তবে শান্ত হয়ে বসো।”
সন্ন্যাসী আবারো তার কথা শুরু করলেন।
“কুকুরের বউ হওয়ার লজ্জা থেকে বাঁচতে নিরং তোমাকে নিয়ে যায় সেই জায়গায়, যেখানে সে তোমাকে খুঁজে পেয়েছিল। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। তুমি ঠিকই রাস্তা খুঁজে তার বাড়িতে পৌঁছে গেলে। তখন সে ভাবলো, তোমাকে যদি গ্রাম থেকে দূরে কোথাও রেখে আসে– তবে হয়তো তুমি পথ খুঁজে পাবে না। পাহাড়ি রাস্তা ধরে নিরং তোমাকে নিয়ে চললো, আঁকাবাঁকা পাথুরে খাঁজে। কিন্তু তুমিও কম চালাক ছিলে না। ঠিকই রাস্তায় নিজের ছাপ রেখে গেলে। গহীন জঙ্গলে তোমাকে ফেলে আসার পরের দিনই তুমি সেই ছাপ ধরে ধরে নিরংয়ের বাড়ি গিয়ে উঠলে। গ্রামের লোকজন নিরংকে নিয়ে যাচ্ছেতাই কথা বলা থামালো না। তোমার প্রতি নিরংয়ের ব্যবহারও খুব বাজে হয়ে গেল, কিন্তু তুমি তো কুকুর– তোমার তেমন কিছু এলো-গেলো না। এক রাতে ধমক দিয়ে পরের দিন আদর করে খাবার দিলেই তুমি আবার খুশি। এমনই এক সকালে নিরং তোমাকে ভালোমতো খাইয়ে-দাইয়ে, আদর করে বেড়াতে নিয়ে গেল পাহাড়ের একেবারে উঁচুতে– শিখরে। সে তোমার আগেই দৌড়ে সেখানে গেল, এবং পৌঁছে দু হাত বাড়িয়ে তোমাকে ডাকতে লাগলো। তুমিও আনন্দে টগবগ করে ছুটলে উপরের দিকে। আর তক্ষুনি নিরং এক ঝটকায় সরে গেল। তুমি ছুটে গিয়ে খুব জোরে ধাক্কা খেলে এক শক্ত পাথরখণ্ডের সাথে। পাহাড়ের গা বেয়ে তুমি গড়িয়ে পড়তে লাগলে, নিরংয়ের চোখেও কান্নার বান আসলো। এমনটা পরিণতি চায়নি সে তোমার জন্য, কিন্তু এর চেয়ে সহজ কোনো উপায়ও ছিল না তার। পাহাড়ের চূড়ায় নির্জন এ এ জায়গায় কেউই আসে না, তাই এখানটাতেই তোমার কাছ থেকে মুক্তি পাওয়া যেত।
সেই থেকে অনেক অনেক বছর কেটে গেছে। যেখানে তুমি মারা গিয়েছিলে, সেই জায়গায় এক অদ্ভুত গাছ ছিল। সেই গাছে বাস করতো এক দুষ্টু ডাইনি, যার কাজই ছিল মানুষ হোক-কুকুর হোক, যাকে পাবে, তারই আত্মা থলেতে পুরে রাখা। আসলে ওগুলোই তার খেলনা ছিল। যখন মন চাইতো, থলে থেকে বের করে নিয়ে নাড়াচাড়া করতো। তোমার আত্মাও সেই ডাইনির কাছেই আছে। বছরের পর বছর কেটেছে, তুমি কুকুর থেকে রাজা হয়েছ। কিন্তু এখনো তোমার আত্মা মুক্ত হতে পারেনি। তাই যখনই ডাইনি থলে থেকে আত্মা বের করে, তখনই তোমার মাথাব্যথা শুরু হয়।”
রাজা এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিলেন। গল্প শেষ হবার পর তিনি এতটা অবাক হলেন যে প্রথমে কিছুই বলতে পারলেন না। দুষ্টু ডাইনির হাতে কব্জা তার আত্মা? কোথায় সেই গাছ? কী এর সমাধান? এমন বহু প্রশ্নে রাজার মাথা ভোঁ ভোঁ করতে লাগলো। এক নিমেষে রাজা ভুলে গেলেন সন্ন্যাসীর শান্ত-স্নিগ্ধ ভাব, তিনি রেগেমেগে চিৎকার করে বললেন, “সন্ন্যাসী! যে করেই হোক এর সমাধান তোমায় বের করতে হবে। নয়তো তোমার গর্দান যাবে!” রাজা রাগে ফোঁসফোঁস করতে লাগলেন। সন্ন্যাসী মুচকি হেসে জানালেন, রোগীর আরোগ্য প্রার্থনাই তার কাজ। তিনি নিজের কর্তব্য পালন করবেন।
কিন্তু কীভাবে? প্রথমেই অবশ্য রানি এবং উপস্থিত সকল উজির-নাজিরকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাজবাড়িতে ফেরত পাঠানো হলো। তারপর রাজা আর সন্ন্যাসী মিলে ছক কষতে বসলেন। তারপর দুজনে মিলে, রাজার প্রিয় এক নাবিকসহ রওনা করলেন সেই উত্তরের দেশে। সেই দেশে, যেখানে রাজার আত্মা বন্দী হয়ে আছে।
সফরের শুরুতেই রাজাকে সন্ন্যাসী বারণ করে দিলেন,
“যদি কোনো নদী বা জলাশয় সামনে পড়ে, কক্ষনো সেখানে থুতু ফেলবে না। আর কোনো অবস্থাতেই কাউকে অসম্মান করবে না।” কিন্তু রাজা কি আর অত সহজে কারো কথা শোনেন? ঠিকই অমান্য করলেন। অবশ্য সেরূপ শাস্তিও পেলেন। সে আরেক গল্প।
আসলে কি, রাজা পান খেতে খুব ভালোবাসতেন। নৌকায় উঠেই তিনি পান চিবুতে আরম্ভ করলেন। আর যতই নৌকা সামনে যায়, ততই ঢেউ বাড়ে। এমনি এক ঢেউয়ের বুকে রাজা পানের পিক ফেললেন। সেই লালচে রঙের পিক গিয়ে নামলো জলের নিচে, এক জলন্তরী সাম্রাজ্যে। রাজ্যের রাজকন্যা তখন বসে সেলাই করছিল। রাজার থুতু গিয়ে যখন তার সুতায় লাগলো, তখন লাল রঙের বুনন দেখে রাজকন্যা ভারি খুশি হলো। তক্ষুনি তিনি বাবার কাছে গিয়ে বায়না ধরলো,” “এমন লাল রঙ যে দিয়েছে– পোষ মানাব সেই প্রাণীকে!”
ওদিকে রাজা-সন্ন্যাসী আর নাবিকের ছোট্ট দল এসে পৌঁছেছে নদীর কিনারে, বনের প্রান্তে। সেই বনের খাড়া রাস্তা। বনের শুরুতেই আছে এক লম্বা গাছ, গাছের মাথায় একখানা ছোট্ট ঘর। খাড়া পথ বেয়ে তারা উঠলেন। ঘরে ঢুকতেই মনে হলো, এমন গোলকধাঁধা কেউ আগে কখনো দেখেনি! রাজা নিজের স্বভাবমতো কর্কশ স্বরে চিৎকার করে উঠলেন। তার চিৎকার শুনে বেরিয়ে আসলো এক অপূর্ব সুন্দরী নারী। তাদেরকে দেখে সে প্রথমে খুব একটা খুশি না হলেও পরে সব কথা শুনে সে তাদের সাহায্য করতে রাজি হলো। আতিথেয়তায় কোনো কমতি রাখলো না। রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে রাজা নারীটির নাম জানতে চাইলে সে বললো, “লোকে আমায় নিরং বলে ডাকে।”
এই সেই নাম! এই সেই নারী! রাজার চোখ আকাশে ওঠে। নিরংকে দেখে তার আজো মনে হয়, এর চেয়ে সুন্দর চোখ পৃথিবীতে আর নেই। নিরংয়ের পরিচয় পেয়ে রাজা সন্ন্যাসীর বলা সব কথা খুলে বলে। নিরং তাকে জানায়, “মুক্তির পথ সামনেই।”
এর পরদিন সকলে মিলে চললো সেই পর্বতচূড়ার উদ্দেশে। সেই ডাইনি যে গাছে বাস করতো, তা মাথা উঁচু করে দেখেও যেন এর শেষ ঠাহর করা যায় না। ডাইনি নিয়েও বহু গপ্পো চালু আছে। বলা হয়, তার কাছে আছে বিশাল এক থলে– আর সেই থলে নিয়ে সে ঘুরে বেড়ায় এদিক-সেদিন বনেবাদাড়ে। যখনই তারা বনের মাঝে ডাইনির এলাকায় ঢুকলো, আকাশে-বাতাসে শুনতে পেলো তার অট্টহাসি। হাসির শব্দ শুনে তারা নদীর কাছে গেল। সেখানেই দেখা মিললো ডাইনির। ডাইনির সাথে নিরংয়ের আগের চেনাজানা আছে। সেও তো কিছু জাদুমন্তর জানে। তাকে দেখে নিরং বললো, “খুব খুশি মনে হচ্ছে!”
ডাইনির জবাব, “তা খুশি হবো না? অনেক দূর থেকেই যে খবর পেলাম, তোমরা আসছো।” এই বলে ডাইনি তার ছুঁচালো দাঁতগুলো বের করে তাকালো। তার ঘন কালো চুলের ছায়ায় যেন আশপাশটায় মেঘ ছেয়ে গেল। ডাইনির কাছে নিরং চাইলো রাজার প্রাণ। কিন্তু অত সহজে তো আর ডাইনি সে আত্মা ফেরত ফেবে না।
ওদিকে নিরংও কম যায় না। দুজনে মিলে তাই শুরু হলো এক প্রকাণ্ড জাদুর লড়াই। একজন এক জাদু ছুঁড়ে দেয় তো অন্যজন তাকে অন্য জাদুতে বেঁধে ফেলে। অনেকক্ষণ পর ডাইনি হার মানলো। তবে এক শর্তে সে নিরংকে রাজার আত্মা ফিরিয়ে দিতে রাজি হলো।
“এক শর্তে দিতে পারি তোমার রাজার আত্মা
যদি না সে ফিরে চায়, যখন ধরবে ফেরার রাস্তা।”
একবার এ বন ছেড়ে গেলে, একবারও আর ফিরে তাকানো যাবে না। এই একটাই শর্ত। রাজার কথা শোনার সবসময়ই বড় বিচ্ছিরি। নিজের আত্মারাম ফেরত নিয়ে, নিরং আর জঙ্গলকে বিদায় জানিয়ে সন্ন্যাসী ও নাবিককে নিয়ে রাজা চললেন নিজের পথে।
কিন্তু সেই যে নদী, আর নদীর নিচের রাজত্ব– ওখানে তো রাজার নামে পরোয়ানা জারি হয়ে গেছে। রাজকন্যার নতুন পোষা প্রাণী চাই। যে প্রাণীর কাছে আছে সুতা বুননের লাল রং!
নদীতে নৌকা ভাসলো। কিছুদূর যেতেই রাজা পেছনে তাকিয়ে দেখলেন, বিশাল এক ঢেউ ছুটে আসছে তাকে নিয়ে যেতে। রাজা বুঝতে পারলেন, তার ভাগ্যে মুক্তি নেই। বিশাল সেই ঢেউ এসে দুষ্টু রাজাকে তুলে নিয়ে চলে গেল। রাজা হয়ে গেল জলের রাজকন্যার পোষা ‘কুকুর’।
ওদিকে রানিকেও সকলে মিলে হাজতে পুরে দিয়েছে। রাজা-রানিবিহীন রাজ্যের লোকজন সুখের সাগরে ভাসতে লাগলো। আর যাই হোক, এমন দুষ্টু রাজা-রানি কারো চাই না!