সে বহুদিন আগের কথা। গাঁয়ের এক কোণে বাস করতো সুশীল নামের এক অনাথ যুবক। বাবা সেই ছোটবেলায় মারা গেলেও মা চলে গেলেন এই ক’দিন আগেই। সেই থেকে সুশীলের নাওয়া নেই, খাওয়া নেই। ঘরদোরে কিছুর কোনো ঠিক নেই। সুশীল শুধু ঘরের কোণে পড়ে থেকে নিজের আগেকার দিন আর মায়ের আদরের কথা মনে করে। মা বেঁচে থাকতে সে কেমন সারাটা দিন সৈকতপাড়ে শামুক কুড়াতে যেত। কতদিন সে আর শামুক কুড়ায় না। ভুলেই গেছে সেসব দিন।
এমন করে বেশ কতদিন কেটে যাবার পর একদিন সব মেঘ ছাড়িয়ে চনমনে রোদ উঠলো আকাশে। সুশীলেরও ইচ্ছে করলো খানিক রোদ পোহানোর। সেই রোদে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়ে হঠাৎ করেই তার মন ভালো হয়ে গেল। আর তক্ষুনি চোখে পড়লো এক অদ্ভুত সুন্দর শামুক। এই শামুক দেখে তার খেতে ইচ্ছে করলো না, বরং ঘরে নিয়ে রাখতে মন চাইলো। তাই সে শামুকটিকে যত্ন করে হাতের তেলোয় নিয়ে বাড়িতে গেল।
সারাদিন ঘোরাফেরা করে ক্লান্ত দেহে সুশীল ঘুমিয়ে পড়েছিল। রাত্রে ঘুম ভাঙতেই সে অবাক হয়ে দেখলো, তার অগোছালো ঘরদোর আর অগোছালো নেই। কে যেন নিপাট যত্নে সবকিছু সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে। ওইতো, ধোঁয়া উঠছে ভাতের হাঁড়ি থেকেও। পাশে সাজিয়ে রাখা থালা-বাসন, তরকারির কড়াই। চোখ কচলে দেখলো সুশীল– স্বপ্ন দেখছে না তো? ঘরে তো সে ছাড়া আর কেউ নেই। কে করবে এইসব? কিছুই না বুঝলেও অন্তত এইটুক সে বুঝলো, আসলে তার জবর খিদে পেয়েছে। অমন সুন্দর ভাতের গন্ধ সামনে থাকলে কি আর না খেয়ে থাকা যায়? সে বেলা সুশীল আরাম করে ভাতটাত খেয়ে নিলো। তবে মনে মনে পাঁয়তারা করলো, পরের বেলায় সে ঘুমের ভান করে বিছানায় পড়ে থাকবে। দেখতে তো হবে, কে অমন জাদুর মতো ঘরখানাকে প্রাসাদ বানিয়ে দিলো?
পরের বেলা সুশীল একেবারে চুপটি করে শুয়ে থাকলো। একটা টুঁ শব্দ করলো না। যেই সে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করলো, অমনি দেখতে পেলো– কুড়িয়ে আনা সেই শামুক থেকে বেরিয়ে আসছে এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে। সেই মেয়ে চুপি চুপি শামুকের খোলস থেকে বেরোতেই তার আলোর ছটায় সুশীলের জীর্ণশীর্ণ ঘর যেন প্রাসাদের মতো হয়ে উঠলো। আর খোলস থেকে বেরিয়েই মেয়েটি প্রথমে ঘর ঝাট দিল, এরপর চুলায় ভাত বসালো, মাছ কুটলো, সবজি চড়ালো। সব কাজকর্ম করে যখন সে আবার শামুকে ফিরতে যাবে, তখনই সুশীল ঝট করে এসে মেয়েটিকে পাকড়াও করলো– “কে তুমি? অমন করে লুকিয়ে আমার ঘরের কাজই বা কেন করে দিচ্ছ?” মেয়ে একেবারে চুপ। কিচ্ছুটি বলে না। ওর চোখ সেই ঘরের কোণে পড়ে থাকা শামুকের খোলসের দিকে। মেয়েটি বাইরে আসার পর শামুকের খোলসটিও আর আগের মতো সুন্দর দেখাচ্ছে না। সুশীলের ভারি রাগ হলো, তখন সে এক লাথিতে খোলসটি ঘরের বাইরে ফেলে দিল। ভেঙে চুরমার হয়ে গেল খোলসখানা। অমনি মেয়েটি বলে উঠলো– “ও কী করলে? ও কী করলে?”
– এবার তুমি বলো, কে তুমি।
– ঠিক আছে, এখন তো আমাকে ছেড়ে দাও। আমি তো আর খোলসে ফেরত যেতে পারবো না।
সুশীল এবার লজ্জা পেয়ে গেল। মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়ে বললো, “শোনাও তোমার গল্প।”
তখন মেয়েটি এক অদ্ভুত অভিশাপ আর তার অতীত জীবনের কথা শুরু করলো।
“আমার নাম শামুক কন্যা। কতদিন ধরে যে এই খোলসের মধ্যে আমার বাস, বলতেও পারি না। আমি যখন অনেক ছোট, তখন এক দুষ্টু জাদুকর আমাকে এই শামুকের মধ্যে রেখে দিয়েছিল। তার জন্য আমি আমার বাবা-মা, পরিবারের সবাইকে হারিয়েছি। জাদুকর শাপ দিয়েছিল, আমি এই খোলসের বাইরে বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। তবে একটা উপায়ও বলে দিয়েছিল সে। যদি কোনোদিন কোনো মানুষ এসে এই খোলস ভেঙে ফেলে, তবেই আমার মুক্তি। আজ তুমি মনের ভুলে তাই করলে। তুমি আমাকে সেই জাদুকরের অভিশাপ থেকে রেহাই দিয়েছ। আমি তোমার সাথেই থাকব।”
শামুক কন্যার এ কথা শুনে সুশীল যেন হাতে চাঁদ পেল। তখন শামুক কন্যা তাকে এক অদ্ভুত জায়গায় নিয়ে গেল।
এ এমন এক রাজ্য– যেখানে চারদিকে কোথাও কোনো মানুষ নেই। শুধু খাঁ খাঁ ভিজে মাটি আর তাতে ছড়িয়ে আহে অগুন্তি শামুকের খোল। শামুক কন্যা মিষ্টি হেসে এগিয়ে গেল, একটি শামুকের মাথায় হাত রাখতেই শামুকটি মানুষ হয়ে গেল। এরপর একে একে আরো শামুক থেকে বেরিয়ে এলো মানুষের দল। শামুক কন্যার কাছে সুশীল জানতে পেল– আসলে এরা সবাই এ রাজ্যের প্রজা। শামুক কন্যা এ রাজ্যেরই রাজকন্যা।
মুহূর্তেই জেগে উঠলো এক ঘুমন্ত রাজ্য। শামুকের খোল থেকে বেরিয়ে এলো এক গোটা জনসমুদ্র। শামুক কন্যা আনন্দে নেচে উঠে ঢুকে গেল রাজপ্রাসাদে, যেখান থেকে সে জাদুকরের অভিশাপে বিতাড়িত হয়েছিল। পিছু পিছু গেল সুশীলও। প্রাসাদের ভেতরও ছড়িয়ে আছে কতগুলো শামুক। এক এক করে জেগে উঠলো শামুক কন্যার বাবা-মা, অর্থাৎ রাজা-রানিও। আর সাথে তাদের কোটাল, পাইক-পেয়াদা, বরকন্দাজ। এতদিন পর মেয়ে আর নিজের জীবন ফিরে পেয়ে রাজা-রানির আনন্দ আর ধরে না। সুশীলকে তক্ষুনি তারা মেয়ের জামাই করে নিলেন। পরদিনই বুড়ো রাজামশায় ঘোষণা করে দিলেন, “আজ থেকে সুশীলই এ রাজ্যের রাজা।” অভাগা সুশীল এবার রাজা হয়ে শামুক কন্যার পাশে থেকে রাজ্য শাসন করতে লাগলো। আর কোনো দুষ্টু জাদুকর এ রাজ্যে আসার সাহস করেনি কোনোদিন।