জালাল রাজার মনে ভীষণ দু:খ। তার এত বড় রাজ্য, কিন্তু কার কাছে এই রাজ্যের পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে শান্তিতে চোখ বুজবে৷ একে একে সে সাত বিয়ে করল। কিন্তু তবুও কোন ঘরেই সন্তান হল না। মনের দু:খে রাজা উজির আর মন্ত্রীর কাছে রাজ্য বুঝিয়ে দিয়ে বনের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করল৷ সাথে একটা বিছানা আর একটা বালিশ নেয়৷ যেতে যেতে হঠাৎ দেখে খালি মাটিতে একটা লোক ঘুমিয়ে আছে৷ রাজা তখন তাকে বালিশটা দিয়ে দেয়। তারপর আবার হাঁটা শুরু করে। কিছু দূর যাবার পর আবার একজনকে মাটিতে শুয়ে থাকতে দেখে রাজা তাকে বিছানাটা দিয়ে দেয়৷ তারপর একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। স্বপ্নে রাজা এক মুনি ঋষির সাক্ষাৎ পায়। সে তাকে বলে পূর্ব দিকে হেটে গেলে একটা বন আছে৷ সেই বনের মাঝে একটা কলাগাছ আছে যেখানে অনেক কাদি কলা ধরে আছে৷ যে কাদির কলাগুলো পাকা সেইগুলো নিয়ে রানীদের খাওয়ালে তাদের সন্তান হবে৷
রাজা ফিরে এসে রানীদের কলা খেতে আদেশ দিল। বড় ছয় রানী ছোট রানীকে একদম পছন্দ করত না। কারণ সে গরিব ঘরের মেয়ে৷ এজন্য তারা ছোট রানীকে কলা দিল না৷ ছোট রানী দেখতে পেল বাকিরা কি যেন একটা খেয়ে ফেলল। ছোট রানী মাটি থেকে কুড়িয়ে কলার খোসা দিয়ে একটা বড়ি বানিয়ে খেয়ে ফেলল। কিছু দিন পর ছোট রানী গর্ভবতী হল৷ কিন্তু ছয় রানীর কিছু হল না৷ রাজা মহা খুশি হয়ে রানীর যত্ন করতে লাগল। অবশেষে রানীর একটা ফুটফুটে ছেলে হল৷ কিন্তু ছয় রানী সেই ছেলেকে কচুবনে ফেলে দিয়ে ছেলের বদলে একটা ব্যাং রেখে দিল। ব্যাং জন্ম দিয়েছে শুনে রাজা ভীষণ রাগান্বিত হয়ে রানীকে বাগানরক্ষক নিযুক্ত করল। এদিকে কচুবনে রাজার ছেলে এক বাঘ নিয়ে গিয়ে লালন পালন করতে লাগল৷ আস্তে আস্তে কেটে গেল বহু বছর৷ রাজপুত্র বিবাহযোগ্য হলে বাঘ একদিন তাকে এক সন্তানহীন মেষপালকের বাড়ি দিয়ে এলো চুপিচুপি। মেষপালক তার নাম রাখল হারুন।
হারুন একদিন স্বপ্নে দেখল ভীষণ সুন্দরী এক কন্যা। গুঞ্জনকাননের রাজা তাকে আটকে রেখেছে। সে ভাল্লুকদের কাছে বড় হয়েছে৷ এজন্য সবাই তাকে ভাল্লুক কন্যা বলে৷ স্বপ্নে সে হারুনকে বার বার অনুরোধ করে তাকে উদ্ধার করার জন্য। ঘুম থেকে উঠে হারুন দৌড় শুরু করে ভাল্লুক কন্যার সন্ধানে।
অনেক দূর যাবার পর সে ক্লান্ত হয়ে সে এক রাজবাড়ীর সামনে দিঘির সামনে বসে বিশ্রাম নিতে থাকে৷ এসময় তাকে দেখে রাজার খুব পছন্দ হয়৷ রাজা তার মেয়ের সংগে হারুনের বিবাহের প্রস্তাব দেয়৷ কিন্তু হারুনের মনে আছে শুধুই ভাল্লুক কন্যা৷ রাজা তবুও আশা ছাড়ে না৷ তাকে একটা মন্দির বানিয়ে থাকতে দেয় দিঘির পাড়ে৷ কিন্তু হারুন কুমার ছিল ভীষণ দুষ্টু। যে মেয়েই দিঘিতে জল নিতে আসে, হারুন তার কলস ভেংগে দিত গুলতি দিয়ে৷ সব মেয়েরা গিয়ে রাজার কাছে নালিশ করে। রাজা বলে যার যার কলস ভেংগে গেছে তারা যেন রাজবাড়ি থেকে নতুন কলস নিয়ে যায়। কিন্তু হারুন রোজই কারো কলস ভেংগে ফেলে। অতিষ্ঠ হয়ে রাজা জল্লাদকে বলে সে যেন হারুনকে ভয় দেখায়। কিন্তু উলটো জল্লাদকেই ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়।
তারপর সে কাউকে না বলে আবার ভাল্লুক কন্যাকে খুজতে হাটা শুরু করে৷ অনেকটা পথ যাবার পর তার দুই জন মানুষের সাথে বন্ধুত্ব হল। সে তার স্বপ্নের রানী ভাল্লুক কন্যার কথা তাদের বলল। একদিন তারা এক গ্রামে এসে বিশ্রাম করার সিদ্ধান্ত নিল। এক বন্ধু রান্না করবে। কিন্তু রান্না করার পর এক দানব এসে সব খেয়ে ফেলে৷ বন্ধু আবার কিনে এনে রান্না করল। এভাবে সবার সাথেই এমন হল। কিন্তু হারুন রান্না করার পর যখন দানব আসল তখন সে দানবকে এমন মার দিল যে তার এক পা ভেংগে গেল৷ ভয়ে দানব পালিয়ে গেল৷
এরপর তারা তিন জন হাঁটতে হাঁটতে গহীন এক বনে চলে এল। সেখানে এক মন্দিরের দেখা মিলল৷ সেই মন্দিরের দরজায় একটা বাঘ আর একটা হরিন৷ কিন্তু বাঘের সামনে ঘাস আর হরিনের সামনে মাংস। হারুন খাবার দুইটার স্থান পরিবর্তন করার সাথে সাথে মন্দিরের দরজা খুলে গেল৷ সেখানে দেখে তারা দুই অপরূপ কন্যা ঘুমিয়ে আছে। এদের মাথার কাছে রুপার কাঠি আর পায়ের কাছে সোনার কাঠি। হারুন ওদের মাথার কাঠি পায়ে আর পায়ের কাঠি মাথায় দিতেই তারা জেগে উঠল।
ওরা বলল আপনারা কেন এখানে এসেছেন। দানব ত আপনাদের খেয়ে ফেলবে৷ হারুন তখন জানাল যে সেই দানবকে আগেই তারা তাড়িয়ে দিয়েছে। এরপর হারুন দুই বন্ধুর সাথে দুই কন্যার বিয়ে দিল। ওদেরকে একটা গাছ উপহার দিল৷ আর বলল এই গাছ যদি মলিন হয়ে যায় বুঝবে আমি বিপদে পড়েছি৷ এই বলে সে গুঞ্জনকাননের দিকে হাঁটা শুরু করল৷
কন্দর রাজা তার শত্রুর কাছে পরাজিত হয়ে যখন পালাচ্ছিল তখন তার একটা মেয়ে জন্ম নেয়৷ তার রূপে চারিদিক আলোকিত হয়ে যায়৷ কিন্তু এই বনের মধ্যে কিভাবে মেয়েকে লালন পালন করবে? তারা ত নিজেরাই খেতে পায় না। এজন্য তারা মেয়েকে রেখেই বন ছেড়ে চল গেল। তখন একদল ভাল্লুক বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে পালন করে বড় করে তুলল। গুঞ্জনকাননের গোস্বামীর আশা একটা মানুষ বনে এলে তার সাথে ভাল্লুক কন্যার বিয়ে দেবে৷ হারুনকে দেখে গোস্বামী খুব খুশি হল। তাকে তার মনের কথা জানাল। এদিকে ভাল্লুক কন্যাকে দেখার পর হারুন বুঝল এই তার স্বপ্নের রানী। এরপর তাদের বিয়ে হয়ে গেল। দুইজনেই গুঞ্জনকাননেই থাকতে লাগল৷
কিন্তু একদিন এক রাজপুত্র শিকার করতে এসে ভাল্লুককন্যাকে দেখে তার প্রেমে পড়ে গেল। সে বিবাহিত জেনেও সে তাকেই চায়। রাজ্যে ফিরে গিয়ে সে পাগলপ্রায় হয়ে যায়৷ তখন এক বুড়ি বলে সে ভাল্লুককন্যাকে নিয়ে আসবে। বিভিন্ন প্রলোভনে ভুলিয়ে সেই বুড়ি ভাল্লুক কন্যাকে রাজপুত্রের কাছে নিয়ে আসে৷
এদিকে গাছের পাতা মলিন হতে দেখে হারুনের দুই বন্ধু বুঝতে পারে তাদের হারুনের বড়ই বিপদ। তারা ছুটে চলে আসে হারুনের কাছে৷ হারুন দুই বন্ধুকে নিয়ে চলে আবার তার প্রিয়তমাকে উদ্ধার করতে। তারা পাহাড় থেকে বড় বড় গাছ কেটে নিয়ে সেই রাজ্যের সবার সাথে যুদ্ধ করে ভাল্লুক কন্যাকে ছিনিয়ে নিয়ে এলো৷
এরপর তারা সবাই মিলে গেল সেই মেষপালকের বাড়িতে যে তাকে বড় করেছিল। ছেলেকে সুখী দেখে সে ত মহা খুশি। সে বিশাল এক ভোজের আয়োজন করলো। সেখানে নিমন্ত্রিত হল সেই ছয় রানী সহ রাজা আর সেই বাঘেরা যারা হারুনকে কচুবনে পেয়েছিল। ভোজের পর সবাইকে মেষপালক হারুনের জন্ম ইতিহাস শুনালো। রাজা যখন জানতে পারল এটাই তার ছেলে সে তাড়াতাড়ি ছোট রানীকে খবর পাঠাল৷ বাগানের কাজ ফেলে সেই রানী এসে হারুনকে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরল৷ এই ত তার সেই হারানো সন্তান। রাজা তারপর ছয় রানীকে মেরে ফেলে ছোট রানী, হারুন আর ভাল্লুককন্যাকে নিয়ে সুখে দিন কাটাতে লাগল।