কা-নাম এবং ব্যাঙের চামড়ার খোলস
সে বহুকাল আগের কথা। জঙ্গলের প্রান্তে, বাবা-মায়ের ঘর আলো করে - সীমান্তের ধারঘেঁষা এক গ্রামে জন্ম নিলো ‘কা-নাম’ নামের এক অপূর্ব সুন্দরী বালিকা। কা-নাম এতই ফুটফুটে সুন্দর ছিল যে মা ভয়ে ভয়ে থাকতেন, পাছে তাদের মেয়ের উপর বদ নজর দিয়ে দেবে, আর নয়তো ধরেই নিয়ে যাবে তাদের প্রাণপ্রিয় রাজকন্যাটিকে! কা-নামের পরিবার অতটা বিত্তশালী না হলেও বাবা-মায়ের তার প্রতি যত্নের কোনো কমতি ছিল না। তবে মায়ের এসব ভয়ভীতিতে খুব একটা কান দিতেন না কা নামের বাবা। তিনি চাইতেন আর সকলের মতোই বেড়ে উঠুক সে। নিজেকে করে তুলুক নিজের মতোই যোগ্য।
দিন ভালোই যাচ্ছিল, তবে একদিন মায়ের ভয় যেন সত্যি হলো। কা-নাম একদিন কলসি নিয়ে জল ভরতে যাচ্ছিল কুয়ার ধারে। তখনই জঙ্গল থেকে এক দুষ্টু বাঘের নজর পড়লো তার উপর। কা-নামকেই রাতের খাবার হিসেবে পেতে চাইলো সে। তবে এই বাঘটি ছিল অন্যান্য বাঘের চেয়েও অনেক বেশি লোভী। তাই সে তক্ষুণি কা নামকে সাবাড় করে না দিয়ে আরো লম্বা এক ফন্দি আঁটলো। সে ঠিক করলো, কা নাম যখন আরো বড় হবে - হৃষ্টপুষ্ট হবে, ততদিন সে কা নামের খেয়াল রাখবে এবং যথেষ্ট বড় হবার পরই সে তার সুস্বাদু খাবারটি গ্রহণ করবে। বাঘের এই নিষ্ঠুর পরিকল্পনা কা নাম বা তার পরিবার কেউই বুঝতে পারেনি। দিনে দিনে বাঘ বিভিন্ন খাবারদাবার দিয়ে কা নামকে আরো সাজিয়ে-গুজিয়ে তুলতে লাগলো। আর এ ভাবেই একদিন কা নাম পরিণত হলো এক রূপে-গুণে অতুলনীয়া তরুণীতে। বাঘের মনে হলো, এই তো সময়! গুহায় বসে সে তার ভোজনের কথা ভাবতে লাগলো, আর নিজের সাথেই কথা বলতে লাগলো–
“অনেক অপেক্ষা করেছি। আর না! এখনই সময় কা নামকে সাবাড় করে দেয়া। সে বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠেছে। জলদিই কাজ সারতে হবে। কালই আমার সঙ্গী-সাথী বাঘদেরকে নিয়ে কা নাম ভোজনে যাব। আর তর সইছে না আমার!”
ওদিকে বাঘের গুহার এক কোণে বাস করতো দয়ালু স্বভাবের একটি ইঁদুর, যে আড়ি পেতে শুনতে পেল বাঘের দুরভিসন্ধির কথা। তার বড্ড মায়া হলো কা নামের জন্য। কিন্তু সে তো ছোট্ট একটি ইঁদুরমাত্র। জঙ্গলের অত বড় প্রাণীর সাথে মোকাবেলা করা কি চাট্টিখানি কথা? তবু কা-নামকে সাহায্য করা থেকে পিছপা হতে পারলো না ইঁদুরটি। সে তার সাধ্যমতোই চেষ্টা করতে চাইলো। সে কা-নামের কাছে গিয়ে সব বুঝিয়ে-শুনিয়ে বললো এবং তাকে পাঠালো এক জাদুকরের গুহায়। সেই জাদুকরের নাম উ-হীনরোহ। উ-হীনরোহ এর জাদুকরী শক্তি কোনো না কোনোভাবে কা নামকে বাঁচিয়ে দেবে, সেই আশাতেই ইঁদুর এই কাজ করলো। কিন্তু বিধি বাম! উ-হীনরোহ ছিল মহাপরাক্রমশালী এক ব্যাঙ, যার কাজই ছিল ছলে-বলে-কৌশলে ও তার জাদুবলে লোকের অনিষ্ট সাধন। সেও কা-নামের সৌন্দর্যের প্রলোভনে পড়লো। সেও তাকে নিজের করে নিতে চাইলো। কা-নামের অবস্থা হলো যাকে বলে ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী।‘ নিজের সৌন্দর্যই যেন তাকে বারংবার বিপদের হাতে ঠেলে দিতে থাকলো। তার সহজ-সরল জীবনে বারবার দেখা দিলো ঝড়ের পূর্বাভাস।
সুরক্ষা প্রদানের নাম করে জাদুকর কা-নামকে উপহার দিলো একটি ব্যাঙের চামড়ার খোলস। তাকে বললো সার্বক্ষণিক এই খোলসটি পরে থাকতে, এবং ভুলেও যেন কারো সামনে আর নিজের রূপ প্রকাশ না করে। অন্যথায়, মৃত্যু! এই ভয়ংকরবাণী শুনে ভয়ে কুঁকড়ে গেল কা-নাম। কিন্তু অন্য কোনো উপায়ও তো নেই তার। একদিকে ক্ষুধার্ত বাঘ, অন্যদিকে চতুর জাদুকর। অগত্যা জাদুকরের কথাই মানতে হলো তাকে। ব্যাঙের চামড়ার খোলস পরিধান করার সাথে সাথে সে একটি কদাকার ব্যাঙে পরিণত হয় এবং মনের দুঃখে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে থাকে।
কা-নামের এই দুরবস্থা দেখে ইঁদুরটির বড্ড মায়া হলো। মনে অপরাধবোধও জন্মালো এই ভুল পরামর্শ দেবার কারণে। তাই সে কা-নামকে নিয়ে গেল জঙ্গলের মাঝখানে এক জাদুবৃক্ষের কাছে। কা-নামকে শিখিয়ে দিলো এক অব্যর্থ জাদুমন্ত্র,
ওঠো বৃক্ষ, ওঠো– বেড়ে ওঠো তুমি উঁচুতে। পৌঁছে যাও আকাশের সম্মুখে, দেখো, আকাশ কত কাছে আকাশে নেই কোনো মেঘ, থেকো না আর ত্রাসে!
বৃক্ষ কা-নামকে পৌঁছে দিল দেবতাদের নীল-জগতে। সেখানে সবকিছু বড় সুন্দর। সকলেই বাস করে মহলে, সকলেই পরে থাকে মণিমুক্তোখচিত পোশাক সব। অথচ অভাগী কা-নাম, তার বিচ্ছিরি-নোংরা ব্যাঙের রূপ দেখে কেউ তার দিকে ফিরে তাকায় না, সকলেরই চোখে ঘৃণা। এত সুন্দর জগতে এসেও জাদুকরের অভিশাপ নিয়ে কা-নাম দুঃখী মনে ঘুরে ফেরে। তার ঘর নেই, মা-বাবাকে ফেলে এসেছে। সবখানে তার বড় বিপদ। এভাবেই একদিন ঘুরতে ঘুরতে সে গিয়ে পড়লো সূর্যদেবীর মহলের কাছে। দেবীর মনে বড় মায়া। তার মহলের কাছে কা-নামকে তিনি থাকতে দিলেন একটি কুটিরে। দেবীর দয়ায় দিন কাটে কা-নামের। রাতে ব্যাঙের দেওয়া খোলস খুলে ঘুমায় কা-নাম, রাতে কেইবা তাকে দেখবে!
একদিন হঠাৎ করে সূর্যদেবীর পুত্রের চোখ পড়ে কা-নামের কুটিরের দিকে। এসে দেখে, শুয়ে আছে এক অদ্ভুত সুন্দরী তরুণী। আঁধার ঘরেও তার ঘুমন্ত মুখমণ্ডল থেকে ছড়িয়ে পড়ছে আলোকচ্ছটা। আর পাশেই রাখা তার দিনের পোশাক - এক কুৎসিত ব্যাঙের খোলস। কা-নামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ না হয়ে পারেনি কেউ, দেবীপুত্রও পারলো না। সে তক্ষুণি মাকে গিয়ে জানালো, কা-নামকেই বিয়ে করতে চায় সে। দেবী প্রথমে পুত্রের কথা খুব একটা কানে তুললেন না, পরে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে এক রাতে গেলেন কা-নামের কুটিরে। একই দৃশ্য দেখে দেবী বুঝতে পারলেন সবকিছু। এই নিদারুণ বন্দিত্ব থেকে ভাগ্যব্যাহত কন্যাটিকে মুক্তি দিতে তক্ষুণি ব্যাঙের খোলসটি ছুঁড়ে দিলেন অগ্নিকুণ্ডে। পুড়ে ছাই হয়ে গেল কা-নামের অভিশাপ। ধুমধাম করে বিয়ে হলো দেবীপুত্রের সাথে এক অতুলনীয়া সুন্দরী কন্যার, যে কিনা ভাগ্যদোষে বারবার খণ্ডন করেছে ভাগ্যকেই।
গল্পটি এখানেও শেষ হতে পারতো। ‘অতঃপর তাহারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো’ বলে টানা যেতো ইতি। কিন্তু এই গল্পের সফর আরো কিছুদূর।
সুখে-শান্তিতেই দিন যাচ্ছিলো নবদম্পতির। কিন্তু পুরনো এক ইতিহাস এসে বাদ সাধলো এবার। বহুকাল আগে থেকেই শত্রুতা রয়েছে সেই দুষ্টু জাদুকর ও সূর্যদেবীর মধ্যে। আর কা-নামের ব্যাঙের খোলস পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা যেন শুধু আগুনে ঘি ঢালার কাজই করলো। রাগে জ্বলে উঠলো উ-হীনরোহ। নিজের গুহা ছেড়ে সে তেড়ে আসলো আকাশে পথে, মোহনীয় সেই নীল জগতে। নিজ জাদুবলে সে সূর্যদেবীকে পরাস্ত করবে, গিলে ফেলবে সূর্যকে– এই উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হলো উ-হীনরোহ এর অভিযান। কিন্তু সূর্যদেবীর মহান শক্তির কাছে এই অশুভ জাদু বেশিক্ষণ সুবিধা করতে পারেনি। এতে অবদান আছে মানবজাতিরও। আকাশের এই সংঘর্ষ দেখে পৃথিবীর মানুষ ঢোল-লস্কর বাজিয়ে অশুভ উ-হীনরোহ এর বিপক্ষে উল্লাসধ্বনি করতে লাগলো। পৃথিবীর এই জয়োল্লাসে উ-হীনরোহও ভীষণ ঘাবড়ে গেলো। ভাবলো, তাকেই বুঝি আক্রমণ করতে আসছে সবাই! আর বেশিক্ষণ যুদ্ধ চালাতে পারলো না, পিছু হঠলো উ-হীনরোহ– জয়ী হলেন সূর্যদেবী, জয়ী হলো পৃথিবীর মানুষ। আরো একবার আঁধারের কাছে জিতে গেলো আলো, মন্দের কাছে - ভালো।
তবে উ-হীনরোহ এর সেই ক্রোধের বহ্নিশিখা আজো নিভে যায়নি। এখনো পাক্ষিক চক্রের নিয়মে সে হানা দেয় নীল জগতের সীমানায়, সূর্যদেবীকে পরাস্ত করবার ভুল ভাবনায়। যুগের পর যুগ পালটে সময় বদলে যায়, বয়ে চলে একই গল্প শুভ-অশুভর সংঘর্ষের। এখনো আকাশে বছরে একাধিকবার সূর্যকে ঢেকে দিতে চায় এক অন্ধকার ছায়া। লোকে তার নাম দিয়েছে ‘সূর্যগ্রহণ’ বা ‘সোলার এক্লিপস’।
পৃথিবীর মানুষ যারা সেই মহাসমর দেখেছিল আকাশের পানে, শুধু তারা জানে– সূর্যগ্রহণ আসলে এক নিষ্ফল জাদুকরের কিছু ব্যর্থ আক্রমণ ছাড়া আর কিছুই নয়। সূর্যগ্রহণের ইতিহাস আসলে এক ভাগ্যভ্রষ্ট তরুণী, একটি লোভী বাঘ, এক দয়ালু ইঁদুর, এক আগ্রাসী জাদুকর আর সূর্যালোকের সাথে মিলেমিশে জীবনের কিছু উত্থান-পতনের। অন্তত খাসিয়া রূপকথা তো তাই বলে।